প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র এবং পৌরাণিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সপ্তাহের ৭ দিনের নামকরণ করা হয়েছে। প্রতিটি দিনের নাম হিন্দু দেবতা ও গ্রহের নামের সাথে সম্পর্কিত, যা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। প্রতিটি দিনের নাম একটি নির্দিষ্ট দেবতা এবং তাদের গুণাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি মূলত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ঐশ্বরিক শক্তির উপস্থিতি এবং প্রভাবকে প্রতিফলিত করে।
রবিবার (Sunday): রবি মানে সূর্য। রবিবারের নামকরণ করা হয়েছে সূর্যদেবের নাম অনুসারে, যিনি হিন্দু পুরাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীনতম দেবতা হিসেবে পরিচিত। সূর্য হলেন জ্যোতির্ময় দেবতা, যিনি পৃথিবীর জীবনের আলো এবং শক্তির উৎস। হিন্দু পুরাণ মতে, ব্রহ্মা তার প্রথম পুত্র হিসেবে সূর্যকে সৃষ্টি করেন। অন্য সূত্র মতে, সূর্য হলেন কশ্যপ ও অদিতির সন্তান। সূর্যের আদি রশ্মিকে সকল প্রাণীর জীবনের উৎস হিসেবে ধারণ করা হয়। এই দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং পূজার মাধ্যমে সূর্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সোমবার (Monday): সোম মানে চাঁদ। এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে চাঁদ বা সোম দেবতার নাম অনুসারে। হিন্দু পুরাণ মতে, সোম অত্রির পুত্র। তিনি দেবতা হিসেবে পূজিত হন, যিনি মনোবল এবং মানসিক শান্তির প্রতীক। তিনি জীবন এবং শক্তির উৎস হিসেবেও বিবেচিত হয়। হিন্দু মিথ অনুযায়ী, দেবতা শিবের সাথে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
মঙ্গলবার (Tuesday): মঙ্গল মানে মঙ্গলগ্রহ। মঙ্গল দেবতার নাম অনুসারে এই দিনের নামকরণ হয়েছে। মঙ্গল দেবতা শিব এবং পার্বতীর পুত্র। তিনি যুদ্ধ, শক্তি এবং দৃঢ়তার প্রতীক। হিন্দু পুরাণে তাকে সাধারণত শক্তিশালী এবং সাহসী যোদ্ধারূপে চিত্রিত করা হয়। মঙ্গলগ্রহের প্রভাব একজন ব্যক্তির জীবনে সাহস, শক্তি এবং নেতৃত্বের গুণাবলী আনে বলে মনে করা হয়। মঙ্গলবারে মঙ্গল দেবতার পূজা করা হয়। এই দিনে বিশেষ উপবাস এবং পূজার্চনা করলে শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায় বলে বিশ্বাস করা হয়।
বুধবার (Wednesday): বুধ মানে বুধগ্রহ। বুধ দেবতার নাম অনুসারে এই দিনের নামকরণ হয়েছে। তিনি সোম (চাঁদ) ও তারার (বৃহস্পতির স্ত্রী) সন্তান। অবশ্য অন্য অনেক সূত্রে, তাকে সোম ও তার স্ত্রী রোহিণীর সন্তান বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণে বুধ দেবতা জ্ঞানের প্রতীক। তিনি বুদ্ধি, বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং সৃষ্টিশীলতার দেবতা হিসেবে পূজিত হন। তিনি বুধগ্রহের অধিপতি। এই দিনে বিশেষ উপবাস এবং পূজার্চনা করলে বুদ্ধি ও বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
বৃহস্পতিবার (Thursday): বৃহস্পতি মানে বৃহস্পতিগ্রহ। বৃহস্পতি দেবতার নাম অনুসারে এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে। বৃহস্পতি হলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। তিনি দেবগুরু হিসেবেও পরিচিত, দেবতাদের উপদেষ্টা এবং শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। হিন্দু ধর্ম মতে, ইনি যার পক্ষে থাকেন, তার ভাগ্য প্রসন্ন হয়। এই দিনে বিশেষ উপবাস এবং পূজার্চনা করলে জ্ঞান ও সৌভাগ্য লাভ হয়।
শুক্রবার (Friday): শুক্র মানে শুক্রগ্রহ। শুক্র দেবতার নাম অনুসারে এই দিনের নামকরণ হয়েছে। হিন্দু পুরাণে শুক্র দেবতা প্রেম, প্রজনন এবং সৌন্দর্যের দেবতা হিসেবে পরিচিত। তিনি অসুরদের গুরু হিসেবেও পরিচিত। তার পুরো নাম শুক্রাচার্য। তিনি বৃহস্পতি দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মহর্ষি ভৃগুর পুত্র। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, এই দিনে বিশেষ উপবাস এবং পূজার্চনা করলে ধন, সৌন্দর্য এবং প্রজননের বর লাভ হয়। এই দিনে সাদা বা উজ্জ্বল পোশাক পরা শুভ বলে মনে করা হয়।
শনিবার (Saturday): শনি মানে শনিগ্রহ। এই দিনের নামকরণ করা হয়েছে শনি দেবতার নাম অনুসারে, যিনি শনিগ্রহের অধিপতি। তিনি সূর্য ও তার স্ত্রী ছায়ার সন্তান। হিন্দু পুরাণে, শনি এক উগ্র দেবতা ও কঠোর বিচারক হিসেবে পরিচিত। তার কুদৃষ্টি খারাপ ফল বয়ে নিয়ে আসে। এই দিনে উপবাস এবং পূজার্চনা করলে শনির কৃপা লাভ করা যায় এবং শনির অপ্রিয় প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, গ্রিকরা যে যে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেবতাদের নাম অনুযায়ী বারের নাম রেখেছিলেন, ভারতবর্ষেও ঠিক সেসব বিষয় সংশ্লিষ্ট দেবতাদের নামেই বারের নামকরণ করা হয়েছ। এই আশ্চর্য মিলের একটি কারণ হতে পারে– হিন্দু জ্যোতিষীগণ গ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
এম/এসএ/দীপ্ত সংবাদ