রিজওয়ান ইসমাম তাসপি।বয়স ২০ বছর। জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন।জন্মের পর যে বয়সে অন্য শিশুরা দৌড়াদৌড়, হৈ চৈতে মাতিয়ে তুলতো পুরো বাড়ি সেখানে রিজওয়ান ছিল একেবারে ভীন্ন। জন্ম থেকেই চোখে না দেখা রিজওয়ান চুপচাপ থাকতো সবসময়।
রিজওয়ানের নিত্যসঙ্গী মায়ের মুখে শুনে শুনে পড়াশোনা করে এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের সরকারি মুজিব কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন দৃষ্টিহীন রিজওয়ান ইসমাম তাসপি।
রিজওয়ান ইসমাম তাসপি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কেজি স্কুল রোড এলাকার মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও শাহনাজ পারভিন দম্পতির পুত্র।
রিজওয়ানের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আট বছর বয়সে পড়ালেখা শুরু করে সে। বিভিন্ন সময় জটিলতার কারণে তার পড়ালেখায় নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। তবে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মায়ের কাছ থেকে পড়া শুনে শুনে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন রিজওয়ান। রিজওয়ানের ইচ্ছে, পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হতে চান তিনি।
পড়াশোনার ক্ষেত্রে রিজওয়ান ইসমাম তাসপির সঙ্গী এবং শিক্ষক তার মা শাহনাজ পারভিন। তিনি বই পড়ে শোনান, ছেলে তা শুনে মুখস্থ করেন। কখনও কখনও তিনি বই পড়ে শোনানোর সময় রেকর্ড করে রাখতেন যা পরবর্তীতে শুনে মুখস্থ করতেন তাসপি।
তাসপির মা শাহনাজ পারভিন বলেন, আমি উত্তর চরকাঁকড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। আমার একমাত্র পুত্র সন্তান তাসপি। আরেকটা কন্যা সন্তান রয়েছে। তার নাম রেজবিন ইমরুল। সে এবার এলএলএম শেষ করেছে। আমার হাত ধরে তাসপি স্কুলে যাতায়াত করতো। তার বাবা চট্রগ্রামে পোস্ট অফিসে চাকরি করেন। ফলে আমার কাছেই তাসপির বেঁড়ে ওঠা। আমার ছেলের পড়াশোনার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। সে প্রচন্ড মেধাবী ফলে কোনো পড়া একবার শুনলে তার মুখস্থ হয়ে যেতো। সে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছি। এসএসসি পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক গণিতে সঠিকভাবে না লেখায় জিপিএ-৫ পায়নি। এসএসসিতে সে জিপিএ ৪ দশমিক ৭২ পেয়েছে। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় সরকারি মুজিব কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছি। শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষায় রিজওয়ানকে শ্রুতিলেখক হিসেবে সহযোগিতা করেন তার থেকে তিন শ্রেণী নিচের স্থানীয় মাকসুদা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শর্মিলি শারমিন।
রিজওয়ানের বাবা মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আমার সন্তানের ফলাফল পেয়ে আমি খুব খুশি। যারা তার পড়াশোনার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সে যেনো মানুষের মতো মানুষ হতে পারে সে জন্য দোয়া করবেন।
রিজওয়ান ইসমাম তাসপি নিজেও তার এ সাফল্যে খুশি। সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষক হতে চান তিনি। রিজওয়ান বলেন, আমি শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় যুক্ত হতে চাই। আমার মতো কোনো শিক্ষার্থীকে যেনো এত কষ্ট না করতে হয় সেই জন্য কাজ করতে চাই। আমার পড়াশোনায় সব থেকে বেশি ভূমিকা আমার মায়ের। শিক্ষক-সহপাঠীরাও আমাকে অনেক সহযোগীতা করেছেন। বিশেষ করে শ্রুতিলেখক এর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি যেনো শিক্ষক হতে পারি সেই জন্য সবাই দোয়া করবেন।
সরকারি মুজিব কলেজের শিক্ষক নুর মোহাম্মদ বলেন, আমাদের কলেজ এর মানবিক বিভাগ থেকে দশজন জিপিএ-৫ পেয়েছে তার মধ্যে তাসপি একজন। তাসপি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। আমরা ক্লাসে যা পড়াতাম, সেগুলো সে মনোযোগ দিয়ে শুনত, আর রেকর্ড করে নিত। কখনোই সে ক্লাস ফাঁকি দিত না। তার সাফল্যে আমরা সবাই খুশি। আশা করি সে অনেকদূর এগিয়ে যাবে।