বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রশ্নে অনেক রাজনৈতিক দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিও তুলছেন।
সম্প্রতি এ নিয়ে একটি সেমিনারে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টিসহ অনেক রাজনৈতিক দল আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটের পক্ষে দাবি তুলেছেন।
তবে বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এই পদ্ধতির বিরোধিতা করে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষেই অবস্থান করছে।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা একদিকে যেমন স্বৈরশাসনের পথ রোধ করে, অন্যদিকে এই পদ্ধতিতে ভোটারদের জনমতেরও প্রতিফলন নিশ্চিত হয়।
বিজ্ঞাপন
এমন বড় একটি রাজনৈতিক দলের আপত্তিতে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব কী না সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা কী?
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন।
পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোনো দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে, নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে তা সুশাসন নিশ্চিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।”
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া একটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ও হারের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সব ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে”।
কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, “অনেক সময় খুব সামান্য পার্থক্য থাকলেও অনেক দল সংসদে একটি আসনও পায় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে নূন্যতম ভোট পেলে সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকার সুযোগ রয়েছে সংসদে”।
প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে পার্থক্য কী?
বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো।
ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনে মোট চারজন প্রার্থী চারটি দল থেকে নির্বাচন করছে। এই নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮৫ শতাংশ।
এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনজন প্রার্থীই ২০ শতাংশ করে ভোট পেল। আর চতুর্থ প্রার্থী পেলো ২৫ শতাংশ ভোট।
বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী চতুর্থ প্রার্থীই এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনটি দলের ৬০ শতাংশ ভোট তেমন কোন কাজে আসছে না।
একই ভাবে সারাদেশের অন্তত ২৯০ আসনে যদি একই হারে ভোট পেয়ে চতুর্থ দলটির প্রার্থীরা জয়লাভ করে, তাহলে মাত্র ২৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তারা সরকার গঠনসহ সংসদে একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য করবে।
অথচ বাকি তিন দল মিলে ৬০ শতাংশ ভোট পেলেও তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকলো না সংসদে। এতে সংসদে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকে না।
নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই পদ্ধতিতে ভোট হলে নিজস্ব ভোট ব্যাংকে কাজে লাগিয়ে বা স্থানীয় ইমেজ কাজে লাগিয়ে কেউ জিতে সরকার গঠন করতে পারে। সেক্ষেত্রে অনেক সময় মেজরিটি ভোটারে মতের প্রতিফলন হয় না”।
আর আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে ভোটের আগে প্রতিটি দল ক্রম ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার প্রাপ্ত ভোটের হার অনুসারে আসন সংখ্যা পাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কিছু রাজনৈতিক দল সারাদেশে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ভোট পেলেও সংসদে তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব থাকে না আসনভিত্তিক একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হওয়ার কারণে। এই পদ্ধতিতে ভোট হলে সে সব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকবে”।
এই প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, সব দল রাজি হলে এরকম একটি ব্যবস্থার ব্যপারে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
বিশ্বের যে সব দেশে এই পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে তার উদাহরণ টেনে বিশ্লেষকরা বলছেন, শিগগিরই চালু না হলেও ধীরে ধীরে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটের পথে হাটতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে।
সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা গত এক দশকে বিভিন্ন সময়ে আনুপাতিক হারে নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে সুপারিশ করে আসছিল।
তাদের মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নানা বিতর্ক যেমন রয়েছে, তেমনি বর্তমান পদ্ধতি ভোটে যে কোন রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারি হয়ে উঠলেও তা রোধ করা যায় না।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে এই পদ্ধতিতে ভোট চালু করা যায়। সেক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতে কী কী লাভ হয়েছে সেটি বিশ্লেষণ করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব।
বিবিসি বাংলাকে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার অসুবিধাগুলো আমরা দেখেছি। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার অসুবিধা আমরা দেখিনি। এটা চালু করতে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। তবে সেটি খুব কঠিন কিছু নয়”।
এই পদ্ধতির ত্রুটিপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরে এই সংকটকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছেন নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অধ্যাপক আহমেদ বলছিলেন, এই পিআর পদ্ধতিতে ভোটে যে সরকার গঠন হয় সেটি স্থিতিশীল হয় না। কারণ এই পদ্ধতিতে ভোট হলে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না।
যে কারণে আনুপাতিক নির্বাচন করতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতেই জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
এজে/এসএ