সালটা ১৯৭৩। মাওলানা আব্দুর রবের বয়স তখন ২৫। এই বয়সেই কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ বাজারে অবস্থিত মনোহরগঞ্জ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামের দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর একে একে কেটে গেছে ৫টি দশক। বয়সের ভারে সময় হয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরের ইমামতি জীবনের ইতি টনার। জীবনের ৭৫ বছর বয়সে এসে অবশেষে ইমামতি অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে তাঁর।
তবে প্রিয় ইমামের বিদায়কেও স্বরণীয় করে রাখতে ভুল করেননি মুসল্লিরা। বিদায় বেলায় প্রিয় ইমামকে দিয়েছেন রাজকীয় সংবর্ধনা। বিদায়ের দুইদিন আগেই মসজিদসহ আশপাশের এলাকাকে সাজানো হয় আলোকসজ্জায়। সর্বশেষ শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) জুমার নামাজ পড়িয়ে ইমামতি জীবনের ইতি টানেন মাওলানা আব্দুর রব। এদিন জুমার নামাজ শেষে সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
শুক্রবার বাদ জুমা মসজিদ মিলনায়তনে এ উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম। পুরে আয়োজনটি করেন মসজিদের মুসল্লি কমিটি। এতে বক্তব্য রাখেন মুসুল্লি কমিটির আহ্বায়ক শাহ আলম, বাজার পরিচালনা কমিটির পক্ষে কামাল হোসেন, মসজিদের মুসল্লি অধ্যক্ষ আব্দুল মতিন, ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন মিলন, এ এস এম মাহবুবুর রহমান হেলাল, কাজী মিজানুর রহমান, মোক্তার হোসেন সুমন, ডা. জসিম উদ্দিন, সার্ভেয়ার মনিরুজ্জামান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের বর্তমান খতীব মাওলানা আব্দুর রহমান প্রমুখ।
এদিন দুপুরে প্রিয় ইমামকে বিদায় জানাতে প্রতিকূল আবহাওয়ায় ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত মুসল্লি এ সংবর্ধনায় সমবেত হন। এ সময় অশ্রুশিক্ত নয়নে প্রিয় ইমামকে বিদায় জানান তাঁরা। মাওলানা আব্দুর রবের বাড়ি মনোহরগঞ্জ উপজেলার ডুমিরিয়া গ্রামে। সাত ছেলে, পাঁচ মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট, নগদ ৫ লাখ টাকার চেকসহ নানা উপহার তুলে দেওয়া হয় মাওলানা আব্দুল রবের হাতে। এ সময় মুসল্লিদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন ইমাম মাওলানা আব্দুর রব। পরে তারা প্রিয় ইমামকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে। এছাড়া ওই ইমামের বিদায় উপলক্ষ্যে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার মসজিদের অন্তত ৩০ জন ইমামকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ সম্মাননা উপহার।
আয়োজক ও স্থানীয়রা জানায়, ১৯৭৩ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মনোহরগঞ্জ বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব নেন মাওলানা আব্দুর রব। এই সময়ের মধ্যে ৭৫ বছর বয়সী মাওলানা আব্দুর রব বর্তমানের নান্দনিক মসজিদটি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ইমামতির শুরুতে তিনি সম্মানি পেতেন ৪০ টাকা আর সবশেষ তিনি মাসিক সম্মানি পেতেন ২০ হাজার টাকা। আব্দুল বর উপজেলা সদরের মনোহরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সাবেক ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন। ৪২ বছরের শিক্ষকতা শেষে সেখান থেকেও এরই মধ্যে অবসরে গেছেন তিনি। দলমতনির্বিশেষে তিনি এলাকায় একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব । প্রিয় ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান জানাতে মনোহরগঞ্জ বাজারস্থ বিভিন্ন সড়কে করা হয় তোরণ নির্মাণ, মসজিদ ও বাজার এলাকায় আলোকসজ্জাসহ মুসল্লিদের উদ্যোগে করা হয়েছে নানা আয়োজন। বাজারের ব্যবসায়ীরাও তাকে সংবর্ধনা জানাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, এই এলাকায় যারা গুণিজন তাদেরকে সবসময় সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় উপজেলার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামকে ৫০ বছরের ইমামতির পর বিদায় বেলায় সম্মান জানাতে এই আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে, এমন সংবর্ধনায় সিক্ত হয়েছেন বলে জানান মাওলানা আব্দুর রব। তিনি বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব সময় সততার সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের চেষ্টা করেছি। কখনো ভাবিনি আমার বিদায়টা এতো সম্মানের হবে। আমি এমন উদ্যোগের জন্য মসজিদের মুসল্লি, এলাকার ছাত্র–যুব সমাজ, বাজারের ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সত্য বলতে আমি আবেগাপ্লুত। আমি সবার জন্য দোয়া করি। আপনারাও আমার জন্য দোয়া করবেন।
মোরশেদ আলম/দীপ্ত নিউজ