কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয়না, বরং নারী হয়ে উঠে (পরিবারে, সমাজে, গোত্রে, রাষ্ট্রে)। এমন বাক্য শুনে চিন্তার জগতে নতুন খোরাক আসতেই পারে। যার জন্য মনে হতে পারে নারী কে? একটা পরিবারে নারী কিভাবে বড় হয়ে উঠে ? তবে এমন প্রশ্ন হওয়াটা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক! ।
এই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তিটি করেন নারীবাদের ‘আইন্সটাইন’ সিমোন দ্য বোভোয়ার। তার লেখা ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বাদী বই, যা সভ্যতার ইতিহাসে আর একটিও লেখা সম্ভব নয়। ‘second sex’ বইতে নারী জীবনের প্রতিটি অধ্যায় কে বিশ্লেষণ করেছেন। যা আজকে জন্ম নেয়া শিশু থেকে নারীর বৃদ্ধ কাল পর্যন্ত। শত-শত উদহারণ দিয়েছেন ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ভিত্তি করে। দ্বিতীয় লিঙ্গের ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরজীবি প্রাণীকুল থেকে মানুষ জীব পর্যন্ত। যা নারীবাদ আন্দোলনের মূল শক্তিকে অনুপ্রেরণার ধাক্কা দিয়েছে। সেই ধাক্কায় মুক্তি হয়েছেন নারী সীমাবদ্ধতার। যেখানে এক আরেককে পরিনত করতে চায় অপর-এ, এক হয়ে উঠতে চায় কর্তায়, অপরকে পর্যবসিত করতে চায় কর্মে।লেখিকা দুই’টা বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন তরুণী থাকা অবস্থায়। যুদ্ধকালীন সময় নারীর করুণ অবস্থা তাকে কাদিয়েছে, তেমনি যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নারীকে পণ্যের মাধ্যমে উপস্থাপনা কে ভাবিয়েছে। আসলে নারীর অবস্থান কোথায়? নারীর কী কোন নিজেস্ব সত্তা আছে? সত্তা থাকলে কিভাবে নিজেক পণ্য হিসাবে পরিচয় করায়? না অন্য কেউ পণ্য হতে বাধ্য করছে? মূলত লেখক ল্য দ্যজিয়েম সেক্স গ্রন্থে নারীর অপ্রয়োজনীয়, বিকলঙ্গ, সীমাবদ্ধ দাসী ও কাম সামগ্রির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।
কারন সতের শতক থেকে উনিশ শতকে শুরুর দিকে নারীদের একঘোর অন্ধকার সময়। মাঝে নারী অধিকার লেখালেখি শুরু হলে বিশ্বযুদ্ধ তা থামিয়ে দেয়। বিংশ শতকের শতাব্দীতে সদ্য দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া নারীদের ধাক্কিয়ে ঘরসংসারে, রুপ দিতে চেয়েছিল ‘নারী চিরন্তনী’ কে। নারী জাতীর এমন পরিস্থিতিতে এক ধ্রুপদী, দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, নারী রাজনৈতিক ভাষ্য হয়ে উঠে সিমোন বোভোয়ার। তিনি বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, দর্শন মাধ্যমে উদঘাটন করেন নারীর পরিস্থিতি ও তার বড় হওয়ার সামাজিক ও পারিবারিক চিন্তা ভাবনা। যা পুরুষতাত্ত্বিক সমাজের দেয়ালকে চূর্ন-বিচূর্ন করে দেয়। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় নারী পরিস্থিতি ও অস্তিত্ববাদী নীতিশাস্ত্রের চিন্তাভাবনার জায়গা। যেখানে মানুষ মানেই বিকাশিত হওয়া। নতুন কে আবিষ্কার করা। সৃষ্টি অস্তিত্বকে বুঝা ও জীবনের চিরন্তন দর্শনগুলি প্রকাশ করা। এখানেই হওয়ার কথা নারী ও পুরুষের বসবাস। তবে পুরুষ নিজেক মুক্ত করে নিয়েছে নিরর্থক জৈবিক দাসত্বের শিকল থেকে কারন সে আবিস্কার করে, ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। কিন্তু নারী? ইতিহাসব্যাপি বঞ্চিত করা হয়েছে পরিবার ও সমাজের প্রত্যেকটাস্তর থেকে। সেই সুযোগ নিয়ে পুরুষ পরিচয় করিয়েছে রহস্যময়ী, অ-মানুষ,মানুষ হিসাবে তার মূল্য নেই, চিরন্তন অপর ইত্যাদি। যা পিতৃতন্ত্রের ছাঁচে ঢালাই করে উৎপাদন করে উপভোগ্য বস্তু বানানো হয় নারীকে। তখনই মনে করা হয় ‘মাংসের উত্তান’ (শিন্নি) সব ক্ষমতার উৎস।

সিমোন দ্য বোভোয়ারের ( second sex)
ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে পুরুষতন্ত্র তৈরি করে মিল-অমিল, শুভ-অশুভ, দূর্বল-সবল, ভাল-মন্দ পার্থক্য। যার কারনেই শুভ দিকটা নিজের জন্য রেখে দেয় পুরুষ। অশুভ দিকটা চাপিয়ে দেয় নারীর উপর। তাহলে নারী কে বা কী? কোন উপায়ে তাকে তৈরি করা হয় নারী হওয়াতে? মানব জাতীর অর্ধেক অংশ নারী। তারপরও নারীত্বের অবস্থান সমতুল্য নয়। তাকে উপদেশ দেওয়া হয় নারী হতে, নারী থাকতে, নারী হয়ে উঠতে, এতেই মনে হয় সবাই নারী নয়। নারী রুপে বিরচিত হতে হলে তার থাকতে হবে, সে-রহস্যময়তা ও অশুভ চরিত্র যাকে বলা হয় নারীত্ব। পুরুষেরা পরিবার ও সমাজে নারী সম্পর্কে যা কিছুই বলে বা লিখে তার সবই সন্দেহজনক। কেননা পুরুষ একই সঙ্গে বিচারক ও বিবাদী। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, সিমোন বোভোয়ার, ডি এইচ লরেন্স, ব্রেতো, মঁতেরঁল নারীবাদী কিংবদন্তি ছিল বলে ইউরোপ ও পশ্চিমা অঞ্চলে নারী দাসত্বের শিকল ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু তার বিপরীত এশিয়ার অঞ্চলে। নারী ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ, কুসংস্কার চর্চা, সল্পো শিক্ষা, ঘরকোনা রাখা, পুরুষ নির্ভর জীবন ব্যবস্থা ইত্যাদি। যার কারনে নারী তার জীবন উদ্দেশ্যর সুর বাধেন পুরুষের ইচ্ছা মতন। জীবন-মরন সমস্যার সিন্ধান্তে তাকিয়ে থাকে পুরুষের দিকে।
নারীর অর্থনৈতিক চাওয়া পূরণ করে তার ‘দ্বিতীয় প্রভু’ স্বামী। এই ইতিহাস শতবছরের পুরানো,নারী শিক্ষাই অভিশাপ, কুসংস্কার ছিল ধর্মের মূলমন্ত্র কারন পুরুষের পায়ের নিচে ‘বৌ’/নারী জান্নাত। এই শাসনের মধ্যমনি হয়ে আছে নারী জীবন। শৃংখলা নামে সমাজের কাছে সাজিয়েছে নারীকে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, যেখানে পুরুষ হচ্ছে প্রয়োজনীয়, কর্তা ও পরম তার জন্য নারী হচ্ছে অপর। কারন পুরুষের সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে নারী এখনো সামাজিক ভাবে মুক্তি পায় না। সেখানেই ‘অপর’ অবস্থায় আশা ও ভয়ে সচেতন থাকে তার ২য় প্রভুর প্রয়োজনে। ২য় প্রভুত্ব চর্চা বলতে সমাজ কাঠামোর পুরুষ প্রতাপশালীকে ধরা হয়। বাংলার নারীজাগরনের ডাক দিয়ে ছিলেন, বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া সাখওয়াত, কাদম্বিনী রায়, নূরজাহান বেগম, ইলামিত্র, নীলিমা ইব্রাহিম, রওশন আরা জামিল, কামীনি রায়, আশালতা সেন প্রমুখেরা।
দাসত্বের শিকল ভাঙার ডাক দিলেও সাড়া মেলেনি। কারন ততো দিনে নারীর মগজে ‘অপর’ হওয়ার সুখবানী মজ্জাগত হয়ে গেছিল। পুরুষ সকল শান্তির ‘উৎস’ এমন বিশ্বাস ঢুকে গিয়েছিল, আজকের জন্ম নেয়া শিশু থেকে আগামীকাল মারা যাওয়া বৃদ্ধা পর্যন্ত। যার মুক্তি একুশ শতকে মেলেনি। বছরে ১০ হাজার বাল্য বিবাহ, হাজার দেড়েক নারী খুন, কয়েক ডজন আত্মহত্যার প্ররোচনায় হত্যা, শত-শত নারী পঙ্গুত্ব পায় পুরুষ প্রভুর দ্বারা। আর এটাই মেনে যাচ্ছে নারীরা। তাদের বিশ্বাস বাকশক্তি ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুরুষত্ব ছাড়া কেউ দিতে পারে না। পরিবার থেকেই এমন বিশ্বাস গড়ে তোলা হয়েছে একুশ শতকের নারীদের কাছে। ‘আজকের মেয়ে আগামীর ‘মা’, এই দর্শননীতি নারীকে কর্তার অধীনস্ত করে রেখেছিল, এখন রাখছে, সামনেও রাখবে। এইভাবে তাকে নারী বানানো হচ্ছে। যার কারনে যৌন দাসীর জন্য গণিকালয় জেতে হবে না শিন্নি ধারী পুরুষকে। লাখটাকার কারবারে ‘গুলশান হেরেম খানা’ খোলা যাবে। যেখানে নারী একটা পারিবারিক পণ্য।