বাজারে উৎপাদকের চেয়ে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী
সম্প্রতি দেশে ডিমের উৎপাদন, বিপণন দুর্বলতা এ খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা এবং বর্তমানে ডিমের বাড়তি দামের কারণ নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপ করেছেন কাজী ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন সাইদ শাহীন।
কালের কণ্ঠ : ডিএলএসের তথ্য মতে, ২০২০ সালে দেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে চাহিদার তুলনায় প্রায় ৫৫০ কোটি ডিম বেশি উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে ডিমের দাম হয়েছে সর্বোচ্চ। এই বিপরীতমুখী অবস্থান কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
কাজী জাহেদুল হাসান : আমাদের দেশ বহু বছর যাবৎ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের ডিম আমদানি করতে হয় না, দেশে ডিমের দামও কম। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সীমারেখাটিও আপেক্ষিক। কারণ প্রতিবছর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে ডিমের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৩ সালে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার জন্য ২০২২ সালে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ লাখ ডিম উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২০২১ সালের প্রায় সারা বছর এবং ২০২২ সালের প্রথমার্ধে দেশে চহিদার তুলনায় বেশি ডিম উৎপাদিত হয়। এই মাসগুলোতে ডিমের বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের কম থাকায় খামার মালিকদের মোটা অঙ্কের ক্ষতি হয়। অনেকে খামার বন্ধ হয়ে যায়। ডিমের সরবরাহ কমে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদি কারণে পোলট্রি খাদ্যের কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ডিমের উৎপাদন খরচ এখন ৯.৫০ টাকার কাছাকাছি। তাই গত আগস্টের পর থেকে ডিমের দাম বেড়েছে। এই পরিস্থিতি করোনার সময়েও হয়নি। তখনো কম দামে ডিম বিপণন করা হয়েছে। করোনার শুরুর দিকে অনেকে ডিম কিনে বাড়িতে মজুদ করার চেষ্টা করে, তখন দাম কিছুটা বেড়ে যায়। পরে চাহিদা কমে যায় এবং দাম স্থিতিশীল থাকে।
কালের কণ্ঠ : চাহিদা, জোগান ও দামের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় হবে? সহনীয় দামে ডিম পেতে কী পদক্ষেপ প্রয়োজন?
কাজী জাহেদুল হাসান : আমাদের দেশে ডিমের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই অনুপাতে প্রতিবছর ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ ছাড়া আমিষের অনান্য পণ্যের দাম সম্প্রতি বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে একটি শ্রেণির মানুষের কাছে ডিমের চাহিদা আরো বাড়ছে। বাজারে ডিমের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। আবার ডিমের সহজলভ্যতা নির্ভর করবে কাঁচামালের মূল্যের ওপর। এই মূল্য এখন অনেক উচ্চ পর্যায়ে আছে। আগামী বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটে মূল্য কমার সম্ভাবনা কম, কিন্তু তার পরের বছর কমতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বিবিআইসিসি ও ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, দেশে ডিম উৎপাদনে ৫০টির মতো বড় ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত। অর্ধেক ডিম তারা উৎপাদন করে। ফলে ডিমের বাজারে তাদের অবস্থান সুসংগঠিত হওয়ার কথা। সেখানে দামের ও বিপণন স্থিতিশীলতা আনতে করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে কি বাধা পাচ্ছেন?
কাজী জাহেদুল হাসান : দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি ডিম উৎপাদন করে, এ রকম প্রতিষ্ঠান মাত্র ২০টি। এদের মোট উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ লাখ পিস। দেশের দৈনিক উৎপাদন চার থেকে ছয় কোটি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্য ও বাজারব্যবস্থায় স্থিতি আনার চেষ্টা করে। ডিম উৎপাদনে নিয়োজিত বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান বাজারের সব নিয়ম মেনেই পাইকারি পর্যায়ে ডিম সরবরাহ করছে। কিন্তু পাইকারি ব্যবসা পর্যায়ে ডিমের সেই ধারাবাহিকতা থাকছে না। বাজার ব্যবস্থায় উৎপাদকদের তুলনায় ব্যবসায়ীদের প্রভাব অনেক বেশি।
কালের কণ্ঠ : দাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা কমিশন সম্প্রতি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, এটি কতটা কার্যকর ও সঠিক? নাকি এই ধরনের কর্মকাণ্ড বাজারকে আরো স্থিতিশীল করে তুলছে?
কাজী জাহেদুল হাসান : ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দাম নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আইনগত যেকোনো পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই। ডিম ব্যবসায়ীদের যে ভিত্তিতে জরিমানা করেছে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যোগসাজশে ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে—এমন অভিযোগ আমাদের দেশে কখনো শোনা যায়নি। কিন্তু তারা এক দিনের অভিযানে তার প্রমাণ বের করে ফেলেছে বলে দাবি করছে। যেখানে অন্য কারণে দাম কমেছে, সেখানে তারা কৃতিত্ব দাবি করছে। তারা কাজী ফার্মসের আশুলিয়া বিক্রয়কেন্দ্রে ৪০ থেকে ৫০ জন মিডিয়া রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান নিয়ে আসে। অথচ কাজী ফার্মসের মাত্র একজন কর্মচারী ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে বলে। তারপর মিডিয়ার উপস্থিতিতেই শুরু হয় বিচার। এই মিডিয়া সার্কাসে কিছু পাওয়া যায়নি, কোনো জরিমানা করা হয়নি। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত কয়েক দশক পোলট্রি খাতে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে কাজী ফার্মস। ডিমের বাজারে কম্পানি পর্যায় থেকে কোনো ধরনের অযৌক্তিকভাবে দাম নির্ধারণের সুযোগ আমাদের নেই। সেই সময়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা কিছুটা সুবিধা নিয়েছে। কিন্তু কম্পানি পর্যায়ে আমরা ডিমের সরবরাহ আরো বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সবাইকে নিয়েই এ খাতের উন্নয়ন করতে চাই।
কালের কণ্ঠ : তাহলে বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিকল্প কী উদ্যোগ প্রয়োজন রয়েছে বলে আপনি মনে করছেন?
কাজী জাহেদুল হাসান : বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং সুলভ মূল্যের নিশ্চয়তার জন্য প্রথম প্রয়োজন উৎপাদন উৎসাহিত ও বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, বিপণন ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি করা, যাতে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যেসব পণ্য আমদানি করতে হয় তার বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। এসব পণ্যের কিছু ক্ষেত্রে দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এ ছাড়া মুদ্রা বিনিময় হার এখন আমাদের বিপরীতে যাচ্ছে। ফলে দাম বাড়ার পেছনে একক কোনো ভূমিকা নেই। সেই বিবেচনায় একটি সামগ্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানি পণ্যে শুল্ক ছাড়সহ বাজেটে নীতি সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি এ খাতের উদ্যোক্তাদের কর সমন্বয় করা প্রয়োজন। কৃষি খাতের একটি উপখাত হিসেবে এ খাতের উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছেন না।
কালের কণ্ঠ : গত প্রায় দুই দশক ডিমের অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে শুধু কাজী ফার্মস কাজ করেছে। সম্প্রতি কিছু বিষয়ে ভুল বার্তা গেছে। সেটি দেশের বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে, নাকি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থার বোঝার ঘাটতি রয়েছে?
কাজী জাহেদুল হাসান : বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্পের উন্মেষ, বিকাশ এবং বর্তমানের শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে কাজী ফার্মের বিশেষ অবদান রয়েছে। ক্রমাগত লেয়ার বাচ্চা উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশকে পোলট্রিশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কাজী ফার্মস নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ডিমের উৎপাদন খরচ অন্য ১০০ দেশের চেয়ে কম। আমাদের দেশে কৃষিপণ্য বিক্রি ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে দর-কষাকষি করে হয়ে থাকে, কিন্তু এই সনাতনী পদ্ধতিতে বড় পরিমাণ কৃষিপণ্য অল্প সময়ে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কাজী ফার্মস প্রথম বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে নিলামে কৃষিপণ্য বিক্রির সূচনা করে। কাজী ফার্মস প্রথম সিঙ্গল এজ ফার্ম স্থাপন করে। কাজী ফার্মস উৎপাদনে এবং পণ্যের মানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সমকক্ষ।
কালের কণ্ঠ : আমরা জানি, ডিম এখন উদ্বৃত্ত, কিন্তু সরকার আমদানির কথা বলছে, এটা কি আসলে কোনো হুমকি, নাকি বিকল্প পদক্ষেপ?
কাজী জাহেদুল হাসান : যেসব দেশ থেকে ডিম আমদানি করা যেতে পারে, তার মধ্যে শুধু ভারতে ডিমের মূল্য সামান্য কম। তবে আমদানি খরচ যোগ করলে দেশে উৎপাদিত ডিমের চেয়ে দাম বেশি পড়বে। ডিম আমদানি করে বাজারে ডিমের দাম কমানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমরা এখন ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি দেশের ছোট খামারিদের জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হবে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। তা ছাড়া গ্রাম পর্যায়ে পোলট্রিশিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন নারীরা। ডিম আমদানি অবারিত করা হলে ক্ষুদ্র খামারি, বিশেষ করে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবেন। দেশে খামারিদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ ও অনান্য সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিকভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিই অন্যতম বিকল্প হতে পারে।
কালের কণ্ঠ : চলতি মাসে এক পিস ডিম উৎপাদন এবং ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে আপনাদের কত খরচ হয়েছে? সেখানে ছোট খামারিদের কত খরচ হচ্ছে? দামের পার্থক্য থাকলে ডিম তো বাজারে একই দামে বিক্রি হচ্ছে। তাহলে সমস্যা কোথায় রয়েছে বলে মনে করছেন?
কাজী জাহেদুল হাসান : চলতি মাসে আমাদের একটা ডিম উৎপাদন করতে ৯.৫০ টাকা খরচ হচ্ছে। ছোট খামারের খরচ প্রায় একই, তবে তাদের শ্রমিকের খরচ আমাদের চেয়ে কম। কিন্তু বর্তমান বাজারব্যবস্থার কারণে ছোট খামারিদের ডিমের বিক্রয়মূল্য আমাদের তুলনায় কম। ছোট খামারিদের বিক্রয়ব্যবস্থা সমবায় বা অন্য কোনো উপায়ে উন্নত করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।