ইসরায়েলি আগ্রাসনে ক্ষুধার রাজ্যে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকায় খাবার না পেয়ে আরও অন্তত ১০ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে মধ্য গাজা থেকে সাংবাদিক তারেক আবু আজ্জুম বলেছেন, ‘এখানে ক্ষুধা বোমার চেয়ে বিধ্বংসী হয়ে দাড়িঁয়েছে। বাসিন্দারা এখন পর্যাপ্ত খাবারের আশা করেন না। তারা যেকোনো খাদ্যবস্তুর জন্যই আশায় বুক বাঁধছেন।’
কাতারভিত্তিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এই প্রতিবেদক বলেন, ‘ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ফলে এখানকার মানুষ ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক পাশবিক মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে।’
২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১১১ জন ফিলিস্তিনি খাদ্য সংকটে মারা গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে জানিয়েছেন গাজার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
বুধবার (২৩ জুলাই) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ ত্রাণপ্রত্যাশীসহ অন্তত ১০০ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ২১টি শিশু অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেছে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রায় ৮০ দিন তারা ত্রাণ সরবরাহ করতে পারেনি। এর ফলেই অপুষ্টিতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। সংস্থাটি জানায়, গাজায় খাদ্য সরবরাহ পুনরায় চালু হলেও তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।
মার্সি কর্পস, নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল, রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালসহ ১১১টি মানবিক সংস্থা এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘ক্ষুধাস্ত্র’ ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
বিবৃতিতে বলা হয়, উপত্যকায় ‘গণঅনাহার’ ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ হাজার হাজার টন খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী গাজা সীমান্তের কাছেই ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে সাহায্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকেও বাধা দেওয়া হচ্ছে।
গত মার্চে ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত ২৬ মে থেকে ইসরায়েলের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচটি) নামে নতুন ত্রাণ বিতরণ কাঠামো চালু হয়েছে।
গাজায় চলমান চরম মানবিক সংকটের মধ্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজায় খাদ্য সরবরাহ কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে, যেখানে সীমান্তে ত্রাণবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকলেও তা বিতরণের সুযোগ নেই।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পরিচালক রস স্মিথ বলেন, ‘মে মাস থেকে ত্রাণ সাহায্য বিতরণকেন্দ্রে গুলিতে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ডব্লিউএইচওর ফিলিস্তিন প্রতিনিধি রিক পিপারকর্ন বলেন, ‘ত্রাণ নিতে আসা ব্যক্তিদের ওপর বারবার হামলার ফলে গাজায় অবশিষ্ট কয়েকটি হাসপাতাল ‘বৃহৎ ট্রমা ওয়ার্ডে’ পরিণত হয়েছে।
তিনি জানান, খাদ্যাভাব এতটাই প্রকট যে শিক্ষক, সাংবাদিক, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীরাও স্বাভাবিক কাজ করতে পারছেন না।
গাজার আল–শিফা হাসপাতালের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চিকিৎসক নূর শরাফ বলেন, ‘মানুষ কয়েকদিন ধরে কিছু খেতে পায়নি। অনেক সময় ডাক্তাররাও না খেয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।’
এদিকে গাজা সিটিসহ বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর তীব্র হামলা অব্যাহত। সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় আরও দুই ফিলিস্তিনি সাংবাদিক— ফটোজার্নালিস্ট তামের আল–জা’আনিন ও সম্পাদক ওয়ালা আল–জাবারিকে হত্যা করা হয়েছে।
এর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ২৩১–এ দাঁড়িয়েছে।
এর মধ্যে আল–জা’আনিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফটোজার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করতেন এবং ওয়ালা আল–জাবারি বিভিন্ন সংবাদপত্রে সম্পাদকীয়র দায়িত্বে ছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে, গাজা যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে ইউরোপের পথে রওনা হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ও বন্দিমুক্তি আলোচনার বিষয়ে আলোচনা করবেন।
কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় গাজায় যুদ্ধবিরতি ও অন্তত ৫০ বন্দির মুক্তি নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিচ্ছে। তবে মার্চে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে এ নিয়ে কোনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। সূত্র: ইউএনবি।