রমজানের শেষ দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো ‘ইতিকাফ‘। এটি এমন এক আমল, যেখানে একজন মুসলিম নিজেকে দুনিয়াবি ব্যস্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন। অনেকেই ইতিকাফের সময়সীমা নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকেন—এটি কি ৩ দিন, নাকি ১০ দিন পালন করতে হবে? কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হলো।
আল্লাহ তাআলা কোরআনে ইতিকাফ সম্পর্কে বলেন: “আর তোমরা যখন মসজিদে ইতিকাফে থাকো, তখন তোমাদের জন্য স্ত্রীগমন বৈধ নয়।” (সুরা আল–বাকারাহ: ১৮৭)
এই আয়াতে ইতিকাফ পালনের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও এখানে সময়সীমার উল্লেখ নেই, তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ থেকে আমরা জানতে পারি যে, রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ ছিল তাঁর নিয়মিত আমল।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। ( বুখারি: ১৯৮০,১৯৮১)।
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পালন করেছেন।
হজরত আয়িশা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত: “নবী (সা.) মৃত্যুর পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং তাঁর পর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন।” (সহিহ বুখারি: ২০২৬, সহিহ মুসলিম: ১১৭২) এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া, অর্থাৎ সমাজের কেউ যদি এটি পালন করে, তবে অন্যদের ওপর ফরজ হয় না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করে, আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খাদ্দান্দের দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।” (মুসনাদ আহমাদ: ৭৪৫০, তাবারানি: ৮৯৯৭) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নফল ইতিকাফ একদিন, দুইদিন বা তিনদিনও করা যায়।
রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা এবং এটি ১০ দিন পালন করাই বিধান। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় ইবাদতের উদ্দেশ্যে ১ দিন বা ৩ দিনের জন্য ইতিকাফ করতে চান, তাহলে সেটিও জায়েজ ও নেক আমল হিসেবে গণ্য হবে।
ইতিকাফের শর্তসমূহ
১. ইতিকাফের নিয়ত করা ।
২. রোজাদার হওয়া।
৩. জামাত হয় এমন মসজিদ হওয়া।
৪. মুসলমান হওয়া।
৫. আকেল ও জ্ঞানবান হওয়া।
৬. জানাবাত ও হায়েজ নেফাস থেকে পবিত্র থাকা।
৭. মহিলা তার ঘরে নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতিকাফ করা।
৮. মহিলা ইতিকাফ অবস্থায় ঘর থেকে বের না হওয়া।
৯. মহিলাদের জন্য স্বামীর অনুমতি নেওয়া।
১০. ওয়াজিব ও সুন্নাত ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত কিন্তু নফল ইতিকাফের জন্য রোজা শর্ত নয়।
১১. পাগল না হওয়া।
( সূত্র: ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।
ইতিকাফ ভঙ্গের কারণসমূহ:-
১. ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করা। ২. শরয়ি ও মানবীয় প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া। শরয়ি প্রয়োজন হলো: জুমার নামাজ, ফরজ গোসল ইত্যাদি। আর মানবীয় প্রয়োজন হলো : প্রস্রাব, পায়খানা ইত্যাদি। (ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে, এই সকল কাজ ছাড়া মসজিদের বাহিরে গেলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত।)
৩. ইতিকাফ অবস্থায় জানাযার নামাজে অংশগ্রহণ করা ।
৪. ইতিকাফ অবস্থায় রুগী দেখতে যাওয়া।
৫. যে সকল কাজ মসজিদে করা সম্ভব, ঐ সকল কাজ করার জন্য মসজিদ হতে বের হওয়া। যেমন, ঘুম, খাওয়া।
৬. ইতিকাফ অবস্থায় পাগল বা বেহুশ হয়ে যাওয়া।
৭. ইতিকাফ অবস্থায় কোন মহিলার মাসিক শুরু হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
( সূত্র: হেদায়া, ফাতাওয়ায়ে শামি, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।
ইতিকাফে করনীয়:
ক. বেশি বেশি কুরআন ও হাদিস পাঠ করা।
খ. সিরাতুন্নবী সা. অধ্যয়ন করা।
গ. আম্বিয়া আ.গণের জীবনী পাঠ করা।
ঘ. ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়া।
ঙ. গুনাহ হয় এমন কাজ না করা।
চ. সালিহীনদের কিতাবাদি পাঠ করা।
ছ. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করা।
জ. শরয়ি আহকামের কিতাবাদি পাঠ ও রচনা করা।
ঝ. প্রয়োজন ছাড়া মুবাহ কথা না বলা। ইত্যাদি।
( সূত্র: ফাতাওয়া ও মাসায়েল ই.ফা. ১ম খন্ড)
ইতিকাফে বর্জনীয়:
ক. ব্যবসার উদ্দেশ্যে মসজিদে ক্রয় বিক্রয় করা মাকরূহ।
খ. ক্রয় বিক্রয়ের বস্তু মসজিদে উপস্থিত করা মাকরূহ।
গ. ইতিকাফ অবস্থায় কথা না বলাকে ইবাদত মনে করা মাকরূহ। তবে গুনাহ হয় এমন কথা পরিহার করা ওয়াজিব।
ঘ. ই‘তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন করা, স্পর্শ ও আলিঙ্গন করা বা সঙ্গম করা হারাম।
( সূত্র: ফাতাওয়ায়ে শামি ও ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী )।
এমএম/আল