পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশরিয়ার মাড়মী গ্রামের স্বপন ইসলাম বলেন, আমার বয়স যখন দেড় বছর তখন বাবা আনারুল ইসলামকে হারাই। বাবা মারা যাওয়ার পর মা ফিরোজা বেগম ঢাকায় যান কাজ করতে। কিন্তু মাও রানা প্লাজা ধসে মারা যান। পরে বড় ভাই আমাকে অরকা হোমসে রেখে যান। এখানে লেখাপড়া ও খাওয়া–থাকার কোনো অসুবিধা নেই। ‘এখানে সব আছে; কিন্তু মা নেই’। স্বপন এখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র।
শুধু স্বপন নয়, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল অন্যতম বড় শিল্প দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধস। যা বিশ্ব ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে বাবা মা হারানো ৪৫ জন ছেলেমেয়ের ঠাঁই হয়েছে অরকা হোমসে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার অনেকেরই সন্তান নিঃসঙ্গতা আর অর্থকষ্টে ভুগলেও গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে অবস্থিত অরকা–হোমস–এর নিরিবিলি পরিবেশে বেড়ে উঠছে ৬৬ শিশু, কিশোর–কিশোরী। তাদের মধ্যে ৪৫ জনেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে হতাহতদের সন্তান।
গাইবান্ধার ১০, পাবনার ৭, জামালপুরের ১, রংপুরের ৮, সিরাজগঞ্জের ২, দিনাজপুরের ২, ঢাকা সাভারের ১৯ এবং দেশের বিভিন্ন স্থানের ১৫ জনসহ মোট ৬৪ জন শিশুর ঠাঁই হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এদের কেউ মাকে হারিয়েছে। কারো মা থাকলেও বাবা নেই। এখানে শুধু আশ্রয় নয়, এখানে এসে তারা পেয়েছে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রেরণা। বাকিরাও এতিম–অসহায়। বাবা–মা হারানো বিভিন্ন জেলার এসব শিশুর লেখাপড়া, খেলাধুলা ও বিনোদনসহ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়েছে জেলার অরকা–হোমস নামের এই প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে অরকা–হোমস প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন (অরকা)। আর এখানে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। প্রচলিত দুস্থ আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের কোনো মিল নেই। এখানে থাকা শিশু–কিশোরদের পোশাক–পরিচ্ছদ দেখে বোঝার উপায় নেই তারা এতিম–অসহায়। এ শিশু–কিশোরদের দেখভালের জন্য রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক, সাতজন কর্মকর্তা–কর্মচারী, গৃহশিক্ষকসহ ২২ শিক্ষক। চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে দুটি তিনতলা ভবন, খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, মসজিদ, ক্লিনিক ও বিনোদনের ব্যবস্থা। আর পাশের মুসলিম একাডেমিতে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এবং ফুলছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে হোসেনপুর গ্রাম। সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রকৃতিঘেরা পরিবেশে অরকা হোমস কার্যালয়। ভেতরে আবাসিক ভবন, স্কুল, মসজিদ ও খেলার মাঠ। আবাসিক ভবনে শিশুরা কেউ পড়াশোনা করছে, কেউ খেলাধুলা করছে। সবার মধ্যে আনন্দ। শিশুরা জানায়, ঈদে সবাই বাড়ি যায়। তারা যেতে পারবে না, এতে তাদের দুঃখ নেই। এখানেই তারা ঈদ উদযাপন করবে।
অরকা হোমসে থাকা শিশুদের মধ্যে একজন সৌরভ হাসান। সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার বলমুইপাড়া গ্রামে। বাবা বাদশা মিয়া কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় তার মা কল্পনা বেগম পোশাক শ্রমিকের কাজ নেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান তিনি। এরপর এতিম সৌরভের জায়গা হয় অরকা হোমসে। সৌরভ বলে, ‘আমার যখন সাত বছর; তখন মা রানা প্লাজায় মারা যায়। মার টাকায় আমাদের পরিবার চলত। মা চলে যাওয়ার পর আমাদের ভালো চলছিল না। পরে এখানে রেখে যায় বাবা। আমি এখন ভালো খাচ্ছি, পড়ছি, বেশ ভালো আছি।’
অরকা হোমসে মাতৃস্নেহে বেড়ে উঠা রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার খেয়াডাঙ্গা গ্রামের সাগরিকা মিম জানায়, ভবন ধসে সে মা জাহানারাকে হারিয়েছে। বাবা দুখু মিয়া দ্বিতীয় বিয়ে করে তাকে ভরণপোষণ দিচ্ছিল না। তিন বছর ধরে সে এখানে আছে। এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। লেখাপড়া শিখে সে প্রকৌশলী হবে।
অরকা হোমসে আশ্রয় নেয়া রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার অভিরাম গ্রামের আল আমিন (১৩) জানায়, তার বাবা অনেক আগে মারা গেছে। এরপর মা ফাতেমা বেগম কাজ করতেন সাভারের রানা প্লাজায়। ভবন ধসে মারা যান মা ফাতেমা। এরপর ২০১৫ সাল থেকে আল আমিনের ঠাঁই হয় অরকা হোমসে।
আল আমিনের মতোই মাকে হারিয়ে অরকা হোমসে আশ্রয় নিয়েছে আলিফ মিয়া। তার বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার ধানঘড়া গ্রামে। আলিফ বলে, জন্মের পরেই বাবাকে হারিয়েছি। এরপর মার (দুলালি বেগম) কাছে থাকতাম। কিন্তু ভবন ধসের ঘটনায় মাকে হারিয়ে আমি একা হয়ে পড়ি। আমার দায়িত্ব নেয়ার মতো কোনো স্বজন নেই। তাই আমার জায়গা হয় অরকা হোমসে। আমি এখানে খুব ভালো আছি।
অরকাতে থাকা কিশোরী তাহমিনা আকতার বিথি বলেন, ‘রানা প্লাজায় আমার এক বোন আহত; আরেক বোন নিহত হয়। ওদের টাকায় আমাদের সংসার চলত। পরে মা আমাকে এখানে রাখে। এখানে আমরা সব পাচ্ছি, কিন্তু পরিবারের জন্য কষ্ট হয়।’
রংপুরের মাহিগঞ্জের জেবা আকতার বৃষ্টি বলেন, ‘আমার মা পড়ালেখা না জানার কারণে গার্মেন্টসে গেছে। আমি পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। মায়ের মতো যেন আমাকে গার্মেন্টসে যেতে না হয়।’
সাভারের ওলি হোসেন সেই ঘটনার পর থেকেই চুপচাপ। চোখ মুছে বলল, তার মা ভেতরে চাপা পড়েন। বড়দের হাত ধরে সে প্রতিদিন মার ছবি নিয়ে ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। ১২ দিন পর অধর চন্দ্র মডেল হাই স্কুল মাঠে দেখা মায়ের বিকৃত লাশ আজও তার চোখে ভাসে। হাতে ধরে থাকা ব্যাগে পরিচয়পত্র আর পরনের কাপড় দেখে তার মাকে শনাক্ত করা হয়েছিল। সেই সময় ওলি হোসানের পাশে দাঁড়ায় ‘অরকা’। প্রথমে চট্টগ্রাম অরকা, পাঁচ বছর আগে তাকে গাইবান্ধায় পাঠানো হয়। এখন সে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। বড় হয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে এ রকম জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে চায় সে। তবে ওলির মতোই সবার প্রতিজ্ঞা। লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। একাদশ শ্রেণির জিয়াদ বলল, মুখে যাই বলি। কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় এভাবে পরিবার ধ্বংস হলে মানুষের কি থাকে!
গাইবান্ধা জেলার সাদুল্যাপুরের আল আমিন, সাভারের ফাতেমা আক্তার মিম, তার ছোট বোন সোনালী আক্তার বীথি সবার গল্পই মোটামুটি এক। কারো বাবা–মা নেই। কারো থেকেও নেই। মীম জানালো, দালান চাপা পড়ে তার মা বুকে আঘাত পান। এখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাবা পঙ্গু। তাদের দেখার সামর্থ্য নেই তার। জিয়াদের মা প্রচণ্ড আঘাতে স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন। আল আমিনের মা সেদিনই মারা গেছেন। ‘ট্র্যাজেডি শিশু’রা বড় হচ্ছে, কিন্তু তাদের অনেকের চোখের সামনে মাঝে মধ্যেই ভেসে ওঠে মা কিংবা বাবার ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহ।
অরকা হোমসের মেয়েদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা নুরজাহান বেগমও নিঃসন্তান। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি চাকরি নেন প্রতিষ্ঠানটিতে। এর পর থেকে মাতৃস্নেহে মেয়েদের দেখভাল করছেন তিনি। নুরজাহান বেগম বলেন, ‘আমি বাচ্চাদের কাছে এসেছি; নিজের সন্তান নেই। পরিবারও নেই। এখানে এসে আমার সন্তানের চাহিদা পূরণ হয়েছে। যতদিন বাঁচব, ওদের সেবা করেই যাব। চেষ্টা করছি ওদের মা–বাবার অভাব পূরণ করতে।’
প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মিল্লাদ মণ্ডল বলেন, ‘২০১৪ সালে মাত্র ৮টি বাচ্চা নিয়ে অরকা হোমসের যাত্রা শুরু হয়। এখন এখানে বাচ্চা রয়েছে ৬৪টি। তার মধ্যে ৪৫ জন ছেলেমেয়ে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বাবা–মা হারানো; বাকিরা এতিম অসহায়। তাদের পড়াশোনা থেকে সবকিছুই আমরা দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘এখান থেকে যাতে পড়ালেখা শেষ করে বাচ্চাদের কর্মসংস্থান হয় আমরা সেটাও করব।
অরকা হোমসের তদারকির দায়িত্বে থাকা হোসেনপুর মুসলিম একাডেমির উপাধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে শিশুদের জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে। ওরা যেন ওদের বাবা–মায়ের স্নেহের অভাব বুঝতে না পারে, আমরা সেই চেষ্টাই করছি। একটি শিশু নিজের পরিবারে যেভাবে লালিত–পালিত হয়, এখানেও তাই হচ্ছে।’
এ ব্যাপারে অরকা হোমস পরিচালক জাহেদুল ইসলাম বলেন, সাত জন কর্মকর্তা–কর্মচারী শিশুদের তদারকি করছেন। এখানে বসবাসকারী শিশুদের লেখাপড়া শেষ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরো বলেন, দুই জন চিকিৎসক সপ্তাহে দুই দিন এখানে এসে শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। ঈদে নতুন জামা–কাপড়, পোলাও মাংস খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে ওদের জন্য। অরকা হোমর্স কর্তৃপক্ষ জানায়, রানা প্লাজা ধসের এই দিনটিতে বিশেষ দোয়া, স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠানের সবাই এবং অনেকের আত্মীয়–স্বজনরা অংশ নেন। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন রানা প্লাজা ১ হাজার ১৩৬ জন মানুষ ধসে নিহত হন।
এফএম/দীপ্ত সংবাদ