২১ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস হিসাবে পালিত হয়। গত ২১ শে মার্চ, ২০২৩, মঙ্গলবার, ১৮ তম বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস ও ১০ম জাতীয় ডাউন সিনড্রোম দিবস উপলক্ষে সুইড বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় এবং নিউরো–ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের আয়োজনে সুইড আলমগীর এম. এ. কবীর মিলনায়তনে ডাউন সিনড্রোম দিবস উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এই অনুষ্ঠানকে প্রধান অতিথি হিসেবে অলংকৃত করেছেন নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে সবাইকে সময় দিয়েছেন রাশেদ খান মেনন এমপি, সভাপতি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি; প্রফেসর ডা. মো. গোলাম রব্বানী, চেয়ারপারসন, এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড। এই অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, সচিব, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুইড বাংলাদেশের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া; সুইড বাংলাদেশের মেন্টর জওয়াহেরুল ইসলাম মামুন; মহাসচিব মো: মাহবুবুল মুনির এবং সাংস্কৃতিক সচিব রাশিদা জেসমিন রোজী।
এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল পাঁচটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের ডাউন সিনড্রোম শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষক সহকারি। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হল সুইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম অ্যাসোসিয়েশন, পি. এফ. ডি. এ. ভোকেশনাল ট্রেনিং স্কুল, প্রয়াস এবং ডি. আর. আর.। অনুষ্ঠানে ডাউন সিনড্রোম শিক্ষার্থীরা উপস্থিত সবাইকে মনমুগ্ধকর দলীয় সংগীত ও নৃত্য প্রদর্শন করেন। অনুষ্ঠানে সুইড বাংলাদেশসহ ৩০ জন ডাউন সিনড্রোম শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হয়, এর মধ্যে ৮ জন সুইড বাংলাদেশের শিক্ষার্থী।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে ডাউন সিনড্রোম সম্পর্কে উপস্থিত সবাইকে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়।
আমাদের কোষের মধ্যে ক্রোমোজোমের ভেতরের ডিএনএকে বলা হয় বংশগতির ধারক ও বাহক। শিশুর জন্মের পর তাদের আচার–আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছুই এই ডিএনএর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই ডিএনএ বা ক্রোমোজোমের অসামঞ্জস্য হলে শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি দেখা দেয়। আর এইগুলো হল জেনেটিক ত্রুটি। ডাউন সিনড্রোম এ রকমই একটি জন্মগত জেনেটিক ত্রুটি। ডাউন সিনড্রোম (Down syndrome, সংক্ষেপে DS বা DNS) একটি জেনেটিক দুর্ঘটনা যেখানে ২১ নং ক্রোমোজোমে দুটির স্থলে তিনটি ক্রোমোজোম বিদ্যমান থাকে।
আক্রান্ত শিশুর পিতামাতা জেনেটিকভাবে স্বাভাবিক থাকে। অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের ঘটনা দৈবক্রমে ঘটে থাকে। ভ্রুণে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম থাকে– এরকম প্রতি জোড়া ক্রোমোজমে বিদ্যমান দু‘টো ক্রোমোজমের একটি আসে বাবার কাছ থেকে আর আরেকটি আসে মায়ের কাছ থেকে। ডাউন সিনড্রোম হলে আরও একটি বাড়তি ক্রোমোজম ২১ নম্বর ক্রোমোজম জোড়ের জায়গায় ঢুকে পড়ে৷ তখন ২১তম স্থানে ক্রোমোজমের সংখ্যা ২টির বদলে হয়ে যায় ৩টি। তাই একে ‘ট্রাইসোমি ২১‘ বলা হয়৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯৫ শতাংশ ডাউন সিনড্রোমই এ কারণে হয়ে থাকে৷ ২১ নম্বর ক্রোমোজম সংখ্যায় তিনটি থাকে বলে ২১/৩ অর্থাৎ ২১ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস হিসাবে পালিত হয়।
অন্য শিশুদের তুলনায় ডাউন শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে দেরিতে বেড়ে ওঠে। বেড়ে ওঠার ধাপগুলি যেমন বসতে শেখা, দাঁড়াতে শেখা, হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা—এসব দেরিতে ঘটে। ডাউন সিনড্রোমের ব্যক্তিকে সারাজীবন কিছু রোগের স্ক্রিনিং পরীক্ষা করাতে হয় এর মধ্যে জন্মগত হার্টের সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির সমস্যা, ঘন ঘন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ডাউন সিনড্রোমের কোন প্রতিকার এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। শিক্ষা, যথাযথ যত্ন ও ভালোবাসা এই ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিছু কিছু ডাউন সিনড্রোমের শিশুকে স্বাভাবিক বিদ্যালয়ের শ্রেনীকক্ষে শিক্ষা দেওয়া গেলেও অনেকের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দিতে হয়। জন ল্যাংডন ডাউন (John Langdon Down) নামে একজন ব্রিটিশ ডাক্তার ১৮৬৬ সালে প্রথমবার এই রোগের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেন তাই তার নামে এর নামকরণ করা হয়।
এই দিনে সকালে সুইড বাংলাদেশ জরায়ু মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে জনসচেতনতা মূলক সভার আয়োজন করে। এই আয়োজনে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল লিঃ সুইড বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে। সুইড ল্যাবরেটরী মডেল স্কুল ও সুইড ভকেশনাল ট্রেনিং স্কুল এবং সুইড রমনা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুলের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহন আয়োজনটিকে সফল করে।
উল্লেখ্য যে সুইড বাংলাদেশ একটি জনকল্যাণমূলক, স্বেচ্ছাসেবী, অলাভজনক, অরাজনৈতিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৭ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি মূলত এন. ডি. ডি. (নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজেবিলিটি) বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করে। এন.ডি.ডি. মূলত চার প্রকার। ১. ডাউন সিনড্রোম, ২. অটিস্টিক, ৩. সেরিব্রাল পালসি, ৪. বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সুইড বাংলাদেশ এই চার ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিক্ষার্থী নিয়ে বাংলাদেশের ৫৪২ টি শাখা বিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্রায় ৫০,০০০ এর অধিক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় এনেছে।
সুইড বাংলাদেশ এর শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে সুইড বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়ে (৪/এ ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা–১০০০) অবস্থিত সুইড ল্যাবরেটরী মডেল স্কুলে শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে বড় শিশু ও ব্যক্তিদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি দৈনন্দিন কার্যক্রম প্রশিক্ষণ, সামাজিকরনের প্রশিক্ষণ, ক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ, স্কাউট কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, কর্মদক্ষতা মূলক প্রশিক্ষণ ও থেরাপি প্রদান করার মাধ্যমে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিদের আত্মনির্ভরশীলতা ও সমাজে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। সুইড বাংলাদেশের শাখা বিদ্যালয়গুলো একইভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে সমাজে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তিদের অবস্থানকে দিনে দিনে আরো বিকশিত করে তুলছে।
সুইড বাংলাদেশের বিশেষ কার্যক্রমের মধ্যে সুইড ভকেশনাল ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে বিশেষ ব্যক্তিদের ৯টি ট্রেডকোর্সে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু–সুন্দর বিকাশের মাধ্যমে চাকরি ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভালো অবস্থান তৈরীতে অবদান রাখছে।
সুইড বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে আরও রয়েছে–
এন.ডি.ডি. ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৫০০–৭০০ ব্যক্তিদের বিভিন্ন স্তরে সুইড বাংলাদেশের প্রধান অফিস সহ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সুইড বাংলাদেশের সহযোগিতায় চাকরি প্রদান করা হয়।
এছাড়াও সুইড বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবছর স্পেশাল অলিম্পিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে। স্পেশাল অলিম্পিকে ২০১৭ সাল থেকে প্রায় ১৯৩টির ও বেশি স্বর্ণপদক অর্জন করেছে সুইড বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা।
পাশাপাশি ইন্ডিয়ার ভুবেনেশ্বর, উড়িষ্যা ও নয়াদিল্লিতে আলপনা সোসাইটি নামের প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সুইড বাংলাদেশ কাজ করে। এখানে বিশ্বের প্রায় ২৬টি দেশ একত্রিত হয়ে কালচারাল কম্পিটিশন করে সেখানে প্রতিবছরই সুইড বাংলাদেশ তার সাংস্কৃতিক দক্ষতা প্রকাশ করার মাধ্যমে ১ম হয়ে আসছে।
জাপানের প্যারাআর্ট কম্পিটিশনে সুইড বাংলাদেশ তার শিক্ষার্থীদের ছবি পাঠিয়ে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে ১ম স্থান অধিকার করেছে। গত বছর ২০২১ সালেও ৫ জন বিশেষ শিশুর আঁকা ছবি পাঠিয়ে টপ টেন পজিশন অর্জন করেছে।
এছাড়াও সুইড বাংলাদেশ প্রায় ১৭টি অঙ্গ সংগঠন নিয়ে কাজ করে। তার মধ্যে সুইড বাংলাদেশের স্কুল কার্যক্রম ছাড়াও সরকারের সাথে এডভোকেসি, বিভিন্ন সভা সেমিনারের মাধ্যমে গন সচেতনতা তৈরি, এই কাজগুলো করে আমাদের বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে অবদান রেখে চলছে সুইড বাংলাদেশ।
আমদের সমাজে বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তি, তাদের পরিবার, এই ব্যক্তিদের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, শিক্ষক ও শিক্ষা সহকারী তারা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য সমাজে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় এবং সমাজে তাদের অবদানও থাকে। আমরা সবাই যদি একটুখানি সহমর্মিতা, সহযোগিতা, শ্রদ্ধা, যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে এই ব্যক্তিদের চলার পথকে সহজ করতে পারি, এতটুকুই তাদের জীবনমান উন্নয়নে অসীম অবদান রাখে।
তাবিয়া তামান্না, সুইড বাংলাদেশ