ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরা ভারতীয় সীমান্তবর্তি বরেন্দ্র জেলা নওগাঁ। হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস লুকিয়ে আছে নওগাঁর বুকে। অবশেষে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেলো নওগাঁর আরেকটি ঐতিহ্য বলিহার রাজবাড়ী।
সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বলিহার রাজবাড়ী সংরক্ষনের জন্য প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের সকল প্রক্রিয়া শেষ করে অবশেষে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে এক সপ্তাহ আগে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর রাজবাড়ীর সামনে এই সংক্রান্ত একটি সাইবোর্ড টানিয়েছে। গত ২৪মার্চ ২০২২ তারিখে সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। এরপর ২৫আগষ্ট ২০২২ সালে বাংলাদেশ গেজেট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এই প্রত্নতত্ব স্থাপনাটি গেজেটে প্রকাশ করে।
সূত্রে জানা যায়, গত ৪জানুয়ারি ২০২২ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) স্বাক্ষরিত একটি পত্রে জেলা সদর উপজেলার “বলিহার রাজবাড়ী” প্রত্নস্থলের ভূমির তফসিল জানতে চেয়ে নওগাঁ জেলা প্রশাসক বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। এর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহন কর্মকর্তা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর বলিহার রাজবাড়ীর প্রত্নস্থলের তফসিল জানতে চেয়ে পত্র প্রেরন করেন। এরপর ভূমির তপসিল প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে গত ৩০ জানুয়ারী প্রেরণ করা হয় নওগাঁ সদর উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে। উল্লেখিত ভূমি তপসিলে বর্ণিত প্রত্নস্থাপনাটি ১৯৬৮সালের পুরাকীর্তি আইন অনুসারে সংরক্ষনযোগ্য বিধায় সংরক্ষনের জন্য সুপারিশ করা হয়। পুরাকীর্তি স্থলের জন্য ৩.৬৩ একর ভূমি জরিপের মাধ্যমের নির্ধারন করা হয়।
সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক জয়গির লাভ করে বলিহার জমিদার পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নৃসিংহ চক্রবর্তী। বলিহার জমিদারগন তাদের জমিদারী বিভিন্ন স্থানে নানা স্থাপনা গড়ে তোলেন যার মধ্যে বলিহার রাজ বাড়ি অন্যতম। দেশ বিভাগের সময়কালে বলিহারের রাজা ছিলেন বিমলেন্দু রায়। জমিদারগনের মধ্যে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে বলিহারে একটি রাজ–রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মন্দিরে রাজেশ্বরী দেবীর অপরুপা পিতলের মূর্তি স্থাপন করেন। বলিহারের ৯চাকার রথ এতদঅঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। বলিহারের রাজাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন।
রাজা কৃষ্ণেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুর একজন লেখক ছিলেন। তার লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে কৃষ্ণেন্দ্র গ্রন্থাবলী ১ম ও ২য় খন্ড অন্যতম। দেশ বিভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে রাজা বিমলেন্দু রায় স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। এরপর বলিহার রাজবাড়ি দেখভাল করতেন রাজ বাড়ির কর্মচারীরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরবর্তিতে রাজবাড়ির বিভিন্ন নিদর্শন, আসবাবপত্র, দরজা–জানালাসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট হয়ে যায়। এরপর বেশ কিছুদিন রাজবাড়ির একটি ভবন বলিহার স্কুলের শ্রেণীকক্ষ ব্যবহৃত হয়েছিল। স্কুলের নতুন ভবন নির্মাণ হওয়ার পর স্কুলটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে বর্তমানে রাজবাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।
শুধুমাত্র রাজবাড়ি চত্তরে অবস্থিত মন্দিরে স্থানীয় ভাবে পূজাআর্চা করা হয়ে আসছে। বর্তমানে রাজবাড়ির স্থাপনা যা এখনও টিকে রয়েছে এরমধ্যে রাজবাড়ির সামনে প্রকান্ড তোরন, ভেতরের কাম্পাউন্ডে প্রচীন নাট মন্দির, রাজরাজেশ্বরী মন্দির, জোড়া শিব মন্দির আর বিশাল তিনতলা বিশিষ্ট প্রাসাদ।
নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান মোহাম্মদ ফজলুল করিম আরজু জানান, গেজেট হাতে পাওয়ার পর প্রাচীন স্থাপনাটি সংরক্ষনের আওতায় আনা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের সাইবোর্ড দেয়া হয়েছে। স্থাপনাটি সংরক্ষন ও সংস্কার করে পূর্বের আদলে ফিরিয়ে আনতে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে এই কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে বলিহার রাজবাড়িটি পর্যটক আকর্ষণীয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. গোলাম মওলা বলেন এটি নওগাঁবাসীর জন্য আরেকটি অর্জন। এই ঐতিহ্যটি ধরে রাখা ও সংরক্ষণ করার দায়িত্ব শুধু অধিদপ্তরের একার নয়। এটি সংরক্ষণে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভূমিকা অনেক। এছাড়া আমরা যারা দর্শনার্থী হিসেবে বলিহার রাজবাড়ীতে যাবো তাদেরও রাজবাড়ীর প্রতিটি চিহ্ন ও ইতিহাস সংরক্ষণে অনেক ভূমিকা রয়েছে। মোট কথা শত বছরের এমন ইতিহাস আগামীর প্রজন্মেদের কাছে পৌছে দিতে নওগাঁসহ দেশের প্রতিটি ইতিহাস সম্বলিত পুরাকীর্তিকে আমাদের সকলকে সংরক্ষণ ও রক্ষা করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিতে হবে।
রিপন / আল / দীপ্ত সংবাদ