রবিবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৪
রবিবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৪

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭ মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

মৃত্যুর ৩৫ বছর আগে ১৯৪২ সালে জুলাইয়ের এক সন্ধ্যায় খেলা শেষ হওয়ার আগেই তার বেলা শেষ হয়ে গিয়েছিল। কবি অসুস্থ হবার আগে শ্যামবাজার স্ট্রীটের ১৫/৪ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা স্টেশনে ছোটদের জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান শুরু হলে যথারীতি নজরুল আবৃত্তি করতে শুরু করলেন। হঠাৎ তার জিব্বা আড়ষ্ট হয়ে গেল। পোগ্রামার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় দৌড়ে এলেন। রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হলো কবি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রোগ্রামটি আরেকদিন আয়োজন করা হবে। সে রাতে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় টেক্সিতে করে কবিকে বাড়ি পৌঁছে দেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগের প্রকোপ শরীর ছাড়িয়ে মস্তিকে ছড়িয়ে পড়লো। কবির আচারআচরণে অসংগতি প্রকট হয়ে উঠলো। কথার মাঝে অসংলগ্নতা দেখা দিলো ব্যাপকভাবে।

নজুরুলের বাসার মালিক ছিলেন একজন হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক। তার নাম ডাক্তার ডি.এল. সরকার। ডি.এল. সরকার নিজ উদ্যোগে হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা করেন। কিন্তু তার চিকিৎসায় কিছু সাময়িক নিরাময় হলেও হাতের কম্পন ও জিহার আড়ষ্টতা কোনো ভাবেই কমে নি। কিছু সংবাদপত্রে নজরুলের অসুস্থতার খবর প্রচারিত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আকর্ষনীয় রমরমা সংবাদ ও গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের রাজনৈতিক উত্তেজনার পাশে নজরুলের অসুস্থতার সংবাদ কোন প্রচারই পায় নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত চিকিসৎক কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ নজরুলের অসুস্থতার খবর জানতে পেরে আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা করেন। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায়ও কোন ফল এল না। উপরন্তু ক্রোধের মাত্রাবৃদ্ধি ও জিহ্বার আড়ষ্টতাবৃদ্ধি বেড়েই চলছিল। এর সাথে যুক্ত হয় মস্তিষ্কবিকার। চুরুলিয়া থেকে খবর পেয়ে নজরুলের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠভ্রাতা কাজী সাহেবজান ও কাজী আলী হোসেন দেখতে আসেন। কিন্তু সুসময়ে যারা তাকে চেটে পুটে খেয়েছে, তার মেধাকে পুজিঁ করে ক্ষমতা ও সম্পদের প্রাসাদ গড়েছেন তার দুঃসময়ে সেই সুবিধাবাদীদের কেউই এগিয়ে আসেননি।

১৯৪২ সালের ৯ জুলাই হতে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত নজরুল বেঁচে ছিলেন শিশুর মতো। দীর্ঘ ৩৪ বছর ১২০ দিন পর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রবিবার,সকাল দশটা দশ মিনিটে পুষে রাখা অভিমানের চির অবসান হয়। বাংলা সাহিত্যের চির বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইহলীলা সমাপ্ত করেন। নির্মম মৃত্যুর মূল্যে কবি প্রমাণ করেন এতদিন তিনি জীবিত ছিলেন।

কেমন ছিল কবির শেষ দিনটি? সেদিনের আকাশ ছিল বিষাদাচ্ছন্ন,শ্রাবণের কালো মেঘ ভোর বেলাতেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নীলিমার নীল দিগন্তকে।

১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। ২৭শে আগস্ট সন্ধ্যার পর থেকেই তার শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায। ২৮শে আগস্ট ডাক্তাররা জানান তিনি ব্রঙ্কোনিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। ২৯শে আগস্ট সকালে তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। বুকে কফ জমে গলায় এক ধরনের শব্দ হতে থাকে। কফ বের করার জন্য সাকশন মেশিন লাগানো হয়। সকাল ৯ টার দিকে সিস্টার শামসুননাহার কবির মুখে চার চামচ পানি তুলে দেন। সকাল ৯.১৫ মিনিটের দিকে আবার পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কোনভাইে জ্বরের প্রকোপ কমছিল না। বিভিন্ন ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু কোন উপশম হয় না। বহুকাল কঠিন রোগে ভোগার পর ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া অনেক সময় জীবন অবসান ঘটায়।

কবির শরীর স্পর্শ করা হয়। তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। সকাল ১০ টার দিকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। আরো ১০ মিনিট পরে অর্থাৎ সকাল ১০.১০ মিনিটে হৃদপিন্ডের স্পন্দন, শিরা উপশিরায় রক্ত সঞ্চালন ফুসফুসে বাতাসের আনাঘোনা বন্ধ হয়ে যায়। চির নিদ্রায় আছন্ন কবি পাড়ি জমান অন্যভুবনের দিকে।

কবির মৃত্যু শয্যায় উপস্থিত ছিলেন পি. জি হাসপাতালের প্রফেসর নুরুল ইসলাম, হাসপাতালের সুপারিইনটেনডেন্ট ডাঃ এ আর খান,আবসিক চিকিসৎক ডাঃ সিরাজুল হক, মেট্রোন এরশাদ বেগম, সিস্টার শাসসুন নাহার, বীথিকা রায়, এটেনডেন্ট ব্রাদার ওয়াহিদউল্লাহ ভুঁইয়া। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ ফজলুল হালিম চৌধুরী এবং রফিকুল ইসলাম।

বেতার ও টেলিভিশনে নজরুলের মৃত্যু সংবাদ প্রচার হয়। মুহূর্তে দেশবিদেশে প্রচারিত হয় এই সংবাদ। গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে মানষ ছুটে আসে পি. জি. হাসপাতালে। কবির মরদেহ রাখা হয় পিজি হাসপাতালের কনফারেন্স রুমে। এগারটার দিকে তার মরদেহ কেবিন থেকে বের করে আউটডোরে দোতলায় মঞ্চে আনা হয়। জনস্রোত সামাল দিতে না পেরে পরবর্তীতে তার মরেদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র( টিএসসিতে)

পি. জি. হাসপাতালের সভা কক্ষে নজরুলের কবরের স্থান নির্ধারণের জন্যে এক জরুরী সভা বসে। জাতীয় জাদুঘরের পরিচালক ডঃ এনামুল হক নজরুলের পরিবারের প্রসঙ্গ তুলে আনেন। তিনি নজরুলের একমাত্র জীবিত পুত্র কাজী সব্যসাচী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের(দুই পুত্রবধূ, ৬ জন নাতি নাতনীর) মতামতের প্রাধান্যের কথা তুলে ধরেন। কিন্তু তার মতামতকে সর্ম্পূণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। কেউ কেউ শেরে বাংলার মাজার বা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে কবিকে দাফন করার কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ ফজলল হালিম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নজরুলকে কবর দেবার প্রস্তাব করেন।

অনেক আলোচনার পর বতমান জাদুঘরের কাছে তাকে সমাধিস্থ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেখানে কবরও খোড়া হয়। কিন্তু এনামুল হক পরবতীতে জাদুঘরের সম্প্রসারণের কথা তুললে তার আপত্তিতে সেখান থেকে কিছুটা সরিয়ে বতমান স্থানে নেয়া হয়। অবেশেষে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনকেই নিবার্চিত করা হয়। দুপুর ২টার সময় ট্রাকযোগে কবির মরদেহ টিএসসিতে আনা হয়। বিপুল জনতার ভিড় ঠেলে টিএসসিতে পৌছাতে সময় লাগে এক ঘন্টারও বেশী। হাজার হাজার মানুষ ফুলে ফুলে শেষ শ্রদ্ধা জানায় তাদের প্রিয় কবিকে। বিকেল সাড়ে চারটায় সোহরাওয়াদী উদ্যানে তার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

স্মরনকালের বৃহত্তম এ নামাজের জানাজায় লক্ষাধিকেরও অধিক মানুষ অংশ নেয়। পূণার্ঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নজরুলকে দাফন করা হয়। সেনাবাহিনীর একটি দল গোলা ছুড়ে বিউগল বাজিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখায়। দুই দিন রাষ্ট্রীয় শোক দিবস ঘোষনা করা হয়। সারাদেশে অর্ধ্বনমিত রাখা হয় জাতীয় পতাকা।

জনমানুষের মনের বেদনাকে ভাষায় রূপ দিয়ে বনফুল(বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) এর কলম কেঁদে কেঁদে উঠে। জিজ্ঞাসার আকাঙ্খায় তিনি ব্যক্ত করেন,

কবি নজরুল ইসলাম

এক্ষুনি শুনিলাম তুমি নাকি মারা গেছ!

এটা তো মিথ্যা খবর

তুমি অবিনশ্বর

তুমি বিদ্রোহী বীর

মৃত্যুর কাছে তুমি কি নোয়াবে শির?

বিদ্রোহী নজরুল জীবনে কারোর কাছে মাথা নত করেন নি। মৃত্যুর কাছেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত ধ্যান ও জ্ঞান দিয়ে যৌবনের বন্দনা করে গেছেন। নিপীড়িত প্রবঞ্চিত ও পরাধীন মানুষের প্রতিনিধি হয়ে নজরুল শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে তার মানব জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যতদিন পৃথিবীতে শোষণ অত্যাচার ও লাঞ্ছনা থাকবে, ততদিন নজরুল বেঁচে থাকবে শোষিত ও লাঞ্ছিত জনগণের মুক্তির সংগ্রামে অদম্য মনোবল প্রেরণা ও শক্তি হয়ে।

 

লেখক: দেবব্রত নীল

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More