বিবাহ বার্ষিকীতে কি কেউ চায়না যায়? চায়না তো বিজনেসের জায়গা। যায়না হয়তো, আমরা গেছি, কারণ চায়না পর্যটনের জন্যও কত সুন্দর আর আমাদের কাছে কি ভীষণ আন্ডাররেটেড দেশ তা সেখানে না গেলে হয়তো বোঝা যাবে না। ফেইসবুকের নিউজফিডে চায়নার একটা ভিডিও দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তখনই ইনস্ট্যান্ট প্ল্যান করি এখানেই যাবো। ঢাকা থেকেই প্ল্যান করে গিয়েছি পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি, চায়নার গ্রেট ওয়ালে একটা বাঁধাই করে রাখার মত ছবি তুলবো। পাগলামি উঠে গেল মাথায়, বউকে বললাম বিয়ের শেরওয়ানি আর শাড়িটা স্যুটকেইসে নিয়ে নিতে। সে যাওয়ার আগে নিজেও বুঝতে পারেনি আমি ব্যাপারটা সিসিয়াসলিই বলেছি। আর এগুলো দিয়ে কি হবে সেটাও বুঝতে পারছে না, কিন্তু স্বপ্নের ফ্রেমিংটা তো আমি মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছি। বেনারশি শাড়ি আর শেরবানির ওজন আসলে এত বেশি আর এত বিশাল যায়গা দখল করে যে আমাদের আলাদা একটা স্যুটকেইস নিতে হলো শুধু এই দুইটা জিনিস সাথে নেয়ার জন্য। এবার শুরু হলো ছবিটা কোথায় তুলবো সেই রিসার্চ করা। কারণ চায়নার গ্রেট ওয়াল এত পপুলার আর ক্রাউডেড একটা টুরিস্ট স্পট যে সেখানে ছবি তোলার জন্য একটু স্পেস পাওয়াটাও দুষ্কর। গ্রেট ওয়ালে তোলা প্রায় সব পা
অনেক খুঁজে টুজে রিভিউ দেখে গ্রেট ওয়ালে উঠার ১০ টা এন্ট্রি সাইটের মধ্যে আমরা বেছে নিলাম মুতিয়ানু পয়েন্ট। তবে তখনো ভাবিনি কপালে কি আছে আমাদের। সকালে বিশাল এক ড্যাফেল ব্যাগে শেরওয়ানি, বেনারশি শাড়ী নিয়ে রওনা দিতেই বেইজিংয়ে শুরু হলো স্নোফল। জীবনে প্রথম এত সুন্দর শহুরে স্নোফল দেখতে দেখতেই বেলা অনেকটা নষ্ট করে ফেলেছি। গায়ে মোটা জ্যাকেট, তার ভেতরে থার্মাল ইনার আর হাতে মোটা হ্যান্ড গ্লোভস পড়েও আমরা রীতিমত কাঁপছি। অফলাইন ম্যাপ ধরে ধরে মুতিয়ানু যাবার বাস স্ট্যান্ডে যখন পৌঁছেছি তখন এক লোকাল চাইনিজের সাথে ভাঙা ইংলিশে কিছু কথা বলার পর সে জানালো স্নোফল বেশি হলে এন্ট্রি বন্ধ থাকতে পারে। বেইজিং থেকে প্রায় ৮০ কিলো দূরে মুতিয়ানু যেতে যেতে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলো, তবে এন্ট্রি পয়েন্টে অসম্ভব ঠান্ডা বাতাস। তবে আমি খুশি, কারণ চারপাশ একদম শুনশান। টুরিস্ট নেই বললেই চলে। বিকেল ৫ টায় বন্ধ হয়ে যায় এখানকার এন্ট্রি টিকেট বিক্রি। আমাদের বেজে গেছে সাড়ে তিনটা। তবু হাল ছাড়লাম না, ক্যাবল কারের টিকেট কেটে উঠে বসলাম। যত উপরে উঠছি ঠান্ডা বাতাসে হাত পা অসার হয়ে যাচ্ছে। ক্যাবল কারে একটা জায়গায় নামিয়ে দেয়ার পরও বিশাল উঁচু উঁচু স্টেপ বেয়ে পুরোটা হেঁটেই উঠতে হয়। কাঁধে নিয়ে বয়ে চলেছি বিশাল ওজনের বেনারসি শাড়ি আর কস্টিউম। একটা জায়গায় দুজনে বসেই পড়লাম আর না পেরে। আর একটু বাকি মূল টপে উঠতে। এত বাতাস আর ঠান্ডা থাকবে উপরে তা ভাবিইনি। আর গায়ে ইয়া মোটা জ্যাকেট থার্মাল ইনার পড়েও শীতটা একদম এগুলো ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতে চাচ্ছে। মনের জোর নিয়ে উপরে উঠে চারপাশ তাকিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি। আর চারপাশে আমরা দুজন আর অনেক দূরে একটা ফরেনার কাপল ছাড়া উপরে কেও নেই। কিছুক্ষন আশপাশ ঘুরে দেখে এবার ছবি তোলার প্রস্তুতি।
বউকে বললাম যত দ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিতে। তবে আমরা যখনই কাপড় ব্যাগ থেকে খুলে সেগুলো পড়তে হাতের মোটা গ্লাভসটা খুললাম মনে হচ্ছিল কেও আমাদের হাতে অনবরত সুঁই ফুটিয়ে দিচ্ছে। এক মিনিট হাত গ্লাভসের বাইরে থাকলে আঙুলে কোন বোধ শক্তি থাকছে না। এই অবস্থায় বাতাস কম এমন একটা কর্নারে গিয়ে কোন রকমে জ্যাকেট খুলে গায়ের ইনার থার্মালের উপরেই সবকিছু পড়ে ট্রাইপডে মোবাইল ক্যামেরা সেট করতেই ফোন অফ হয়ে গেলো। আশেপাশে তখন ছবি তুলে দেয়ার মতও কেউ নেই। হায় হায়, এখন? ফোনে ফুল চার্জ আছে, কিন্তু ফোন অফ হয়ে যাচ্ছে! পরে ঢাকায় এসে অবশ্য খুঁজে বের করলাম মাইনাস টেম্পারেচারে ক্যামেরা বা মোবাইল কম্পিটিবল না হলে এমনটা হয়। সাথে ছিল আরেকটা সেকেন্ডারি ফোন। সেটাকে অন করার পর দেখলাম ক্যামেরা ওপেন হলো, ট্রাইপডে ফ্রেমিং সেট করতে আর ফোন চালাতে গ্লাভস ১০ সেকেন্ডের জন্য খুলি,অপশনে ক্লিক করে আবার এক মিনিট গ্লাভস পড়ে হাত গরম করি, এরকম বাজে অবস্থা ঠান্ডার।
ছবিটা একটু খেয়াল করলে দেখবেন গ্রেট ওয়ালেও সাদা বরফ পড়ে আছে কর্নারে। সূর্য ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে লাল হয়ে গেছে। এই সময়টা খুবই দ্রুত শেষ হয়, প্রতি সেকেন্ডে লাইট চেঞ্জ হতে হতে অন্ধকার নেমে আসে। আমি ফোনে ১০ সেকেন্ড টাইমার প্রেস করে গ্লাভস ছাড়া খালি হাতে আগের চেয়ে পাতলা কাপড় পড়ে দৌড়ে গিয়ে আগে থেকে সেট করে দাঁড় করিয়ে রাখা বউয়ের পাশে পজিশনে দাঁড়িয়ে যে হাসিটা ছবিতে দিয়েছি সেটা যে কি পরিমান কষ্টের ছিল সেটা কখনোই এই ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই। টাইমার দিয়ে এভাবে কয়েকবার কয়েকটা আলাদা কয়েকটা শট নেয়ার পর আর কোনভাবেই টিকতে পাড়া যাচ্ছিল না। যখন সূর্য ডুবে গেল কোন রকমে সাজ পোশাক খুলে ঠেসে ব্যাগে ভরে জ্যাকেট পরে আমরা কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। এবার প্রায় অন্ধকারে একই পথে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার পালা। নামতে নামতে আরো দুবার ব্রেক নিতে হয়েছে মাঝে ঠান্ডায়। উপরে কি ছবি উঠেছে বা ঠিক উঠেছে কিনা সেটাও দেখার সময় নেই। রাতে হোটেলে ফিরে জনমানবহীন চায়নার গ্রেট ওয়ালে বিয়ের এক বছর পূর্তিতে ঠিক আমাদেরই বিয়ের পোশাকে সন্ধ্যার কনে দেখা আলোয় তোলা এই ছবিটা দেখে আমরা ভুলেই গেলাম ছবিটা তোলার পেছনের সব কষ্ট।