হজ বান্দার সঙ্গে রবের সেতুবন্ধন তৈরির মাধ্যম। হজ আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে– ইচ্ছা করা, সফর করা, ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কাজ সম্পাদন করা। এক কথায় ঋণমুক্ত শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের ওপরেই হজ ফরজ। আর এই ফরজ কাজে যাওয়ার আগে দরকার কিছু প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির। হজযাত্রীদের প্রস্তুতি আগেভাগে সেরে নেওয়া উচিত।
নিয়তের শুদ্ধতা
প্রতিটি কাজের জন্য নিয়ত আবশ্যক। যে কোনো ধরনের আমল কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত নিয়তের শুদ্ধতা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘নিশ্চয় নিয়তের ওপর আমল নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ০১)
পার্থিব যশখ্যাতির মোহে না পড়ে একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজের নিয়ত করা। হজকে পার্থিব যেকোনও ধরনের খ্যাতির বাইরে রাখতে হবে। অন্যথায় তা রিয়া বা লোক দেখানো আমল বলে গণ্য হবে। হাদিসে রিয়াকে ছোট শিরক বলা হয়েছে। ছোট শিরক বুকে ধারণ করে হজ করলে হজ কবুল না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এমন হজ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! এমন হজের তওফিক দাও, যা হবে রিয়া ও সুনাম কুড়ানোর মানসিকতা হতে মুক্ত।’ (ইবনে মাজাহ : হাদিস ৮৯০)
হজ যাত্রার প্রস্তুতি নেয়া
আপনার হজ যাত্রার প্রস্তুতি নিন। পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে জন্য আপনার পাসপোর্টের ফটোকপি নোটারি করে নিন এবং বিমানের টিকেট ও মেডিকেল সার্টিফিকেটের ফটোকপি করে নিন। অতিরিক্ত ১০ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও ১০ কপি স্ট্যাম্প সাইজের রঙ্গিন ছবি সঙ্গে নিন। মজবুত চাকাওয়ালা মাঝারি বা বড় আকারের ১টি ব্যাগ/লাগেজ সঙ্গে নিন। মূল্যবান জিনিসপত্র (টাকা, টিকেট, পাসপোর্ট ইত্যাদি) রাখার জন্য ১টি কোমর/কাঁধ/সৈনিক ব্যাগ নিন। রোদ থেকে বাঁচার জন্য ছোট সাদা বা বিশেষ রঙের ছাতা অথবা ক্যাপ রাখতে পারেন। সব ধরনের খরচ ও হজ প্যাকেজ সম্পর্কে ধারণা রাখা।
নারীদের ইহরামের কাপড় তাদের স্বাভাবিক পোশাক–পরিধেয়ই। ইহরাম বাঁধার টাওয়াল সেট, এহরাম বাঁধার বেল্ট, মানিব্যাগ, পাসপোর্ট ব্যাগ, জুতা রাখার ব্যাগ, পাথর রাখার ব্যাগ, প্লাস্টিক জায়নামাজ, নখকাটার কাটার বক্স, কাঁধের ব্যাগ, নারীদের হিজাব, নারীদের চুল বাঁধার টুপি, হাত মোজা ও পা মোজা, হাওয়ার বালিশ, বোডিং হোল্ডার, সানক্যাপ, চামড়ার মোজা, তায়াম্মুমের মাটি, মিসওয়াক, ছাতা, গামছা, লুঙ্গি, গেঞ্জি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, টাওয়াল, জুতা, টুপি, তসবি, আতর, বোরকা, সাবান, ব্রাশ–টুথপেস্ট, সুঁই–সুতা, থালা, বাটি, গ্লাস, হজ গাইড ও কোরআন শরিফ।
ব্যাগ ও জিনিসপত্র গোছানো
নিজের প্রতিটি ব্যাগে ইংরেজিতে নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বর ও বাংলাদেশের কাছের কারও মোবাইল নম্বর লিখে রাখুন। বড় ব্যাগ তালাবদ্ধ রাখা খুবই জরুরি। তবে ব্যাগ যত ছোট ও হালকা করা যায়, যাত্রা ততই আরামদায়ক হবে। যেসব জিনিসপত্র সঙ্গে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর একটি তালিকা করা ভালো।
জরুরি কাগজপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী
দীর্ঘ হজযাত্রায় কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা জরুরি। স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদপত্র, টিকাকার্ড, ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার রসিদ, নারী হজযাত্রীর ক্ষেত্রে শরিয়তসম্মত মাহরামের সঙ্গে সম্পর্কের সনদ ইত্যাদি সঙ্গে রাখা চাই।
সব হজযাত্রীর জন্য বাংলাদেশ থেকে একটি পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এতে পিলগ্রিম নম্বর, নাম, ট্রাভেল এজেন্সির নাম ইত্যাদির তথ্য থাকে। এটা গলায় বা হাতের কাছে রাখুন। একটি কাগজে নিজের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, এজেন্সির নাম ও সৌদি আরবে সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সির প্রতিনিধির মোবাইল নম্বর ইংরেজিতে লিখে রাখুন। এ ছাড়া সৌদি আরবে থাকাকালে মোয়াল্লেমের পক্ষ থেকে হজযাত্রীকে পরিচয়পত্রের একটি কার্ড দেয়া হয়। সেই কার্ড ও যে হোটেলে থাকবেন, সেই হোটেলের কার্ড অবশ্যই সঙ্গে রাখুন।
ইহরাম বাঁধা ও মিকাত পেরোনো
ঢাকা থেকে আপনার গন্তব্য মক্কা হলে বিমানে ওঠার আগে ইহরাম বাঁধা ভালো। কারণ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ‘মিকাত’ বা ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান। চাইলে বিমানেও বাঁধা যায়। বিনা ইহরামে মিকাত পার হলে এজন্য দম বা কাফফারা দিতে হয় এবং এটি গুনাহের। ইহরামবদ্ধ হওয়ার পর যাবতীয় নিয়ম–কানুন মেনে চলুন। (ইহরামের নিয়ম জানতে হজ গাইড পড়ুন)। যদি কারও গন্তব্য ঢাকা থেকে মদিনা হয়, তাহলে মদিনা থেকে মক্কায় যাওয়ার সময় ইহরাম বাঁধলে চলবে।
মোবাইল সিম ও মানচিত্র সংগ্রহ
মক্কা গিয়ে মোবাইলের একটি সিমকার্ড কিনুন। পাসপোর্টের কাগজপত্র দেখিয়ে সিমকার্ড কিনতে পারবেন। এয়ারপোর্টে সৌদির বিভিন্ন কোম্পানি সাময়িক মোবাইল সিমকার্ড দেয়। শুধু আঙুলের ছাপ দিয়ে সিমকার্ডগুলো সংগ্রহ করা যায়।
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবপোর্টালে আরাফার ময়দান, মিনা বা মক্কা–মদিনা হজের স্থানগুলোর মানচিত্র দেওয়া আছে। সেখান থেকে মানচিত্র সংগ্রহ করে প্রিন্ট করে নেওয়া যায়। মানচিত্র থাকলে চলতে–ফিরতে সহজ হবে।
হজের যাবতীয় বিধিবিধান জেনে নেয়া
হজ করতে ইচ্ছুক এবং প্রথমবারের মতো হজ করতে যাচ্ছেন এমন ব্যক্তির জন্য অবশ্যই হজের নিয়ম–কানুন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখা জরুরি।
হজ সফরে কোথায় কখন কী আমল করতে হবে, কোন আমল করা ফরজ, কোন আমল ওয়াজিব, কোন আমল সুন্নত ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। একই সঙ্গে হজের তালবিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ দোয়াগুলো মুখস্থ করে নিতে হবে। বিজ্ঞ আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জরুরি বিষয়গুলো জেনে নেওয়া উচিত। কোথাও হজের প্রশিক্ষণ হলে, সেখানে যোগাযোগ করে হজের বিধিবিধান ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত। সম্ভব হলে হজ–সংক্রান্ত বই পড়েও জেনে নেওয়া যেতে পারে।
সুপ্তি/ দীপ্ত সংবাদ