যে সমস্ত দেশগুলিতে বাঘ আছে, সে সমস্ত দেশের মানব অধিবাসীরা স্বদেশী বাঘ নিয়ে খুব গরব করেন। সবাই বলেন, তাদের দেশের বাঘই সবচেয়ে বড়, পরাক্রমশালী।
আমিও ছোটবেলায় শুনতাম আমাদের সুন্দরবনের বাঘই সবচেয়ে বড়। কিন্তু বিজ্ঞান বলে এক অনিকেত নিষ্ঠুর কষ্টিপাথর আছে, যে আমাকে সন্দেহ করতে শেখায়।
সুন্দরবনের ইতিহাসে সরকারিভাবে স্বীকৃত দীর্ঘতম বাঘটি হলো বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজীর শিকার করা আঠারোবাকীর মানুষমারা বাঘটি।
১৯৬৫ সালে আঠারোবাকীর বাঘটি মারা হয়েছিল। সেকালের জাতীয় দৈনিকগুলিতে এটির খবর ছাপা হয়েছিল। মাপে এসেছিল ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। শিকারীকে আমি এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। উনি জানান, আমি শিকার করে দিয়াছিলাম, সাহেবরা মেপেছেন।
পচাব্দী গাজীকে দেয়া বনবিভাগের কিছু সার্টিফিকেট দেখেছি। সেখানে আকসার দশ সাড়ে দশ ফিট বাঘের কথা উল্লেখ আছে।
এদিকে মধ্যপ্রদেশ, কুচবিহার, গৌরীপুর সাওয়াই মাধোপুর রাজবাড়ির শিকার রেকর্ডে বড় বাঘগুলির দৈর্ঘ্য সাড়ে দশ ফিটের আশপাশে দেখতে পাই। অথচ এ এলাকার বাঘগুলি উপমহাদেশের বড় বাঘের নমুনা হিসেবে স্বীকৃত।
প্রণম্য প্রানীবিজ্ঞানী কার্ল বার্গম্যান দেখিয়েছেন, একই প্রজাতির প্রাণী বিষুবরেখা থেকে যত উত্তরে বা দক্ষিণের শীতল এলাকায় বিস্তৃত হতে থাকবে, তার দেহের আকারও বাড়তে থাকবে। কঙ্কাল খুব বড় না হলেও দেহে চর্বির স্তর বেশি হওয়ায় সেটাকে বড় দেখাবে। সে অনুযায়ী বাদাবনের বাঘ ছোট হবার কথা।
তার উপর আর একটি কথা থাকে—আইল্যান্ড ডুয়ার্ফিজম। অর্থাৎ একই প্রজাতি দ্বীপাঞ্চলে আটকে গেলে উপযুক্ত শিকার ও শিকার বৈচিত্র্যের অভাবে প্রাণীটি আকারে ছোট হবে। সে অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘের আকার ছোট হওয়াই ভবিতব্য।
আমি যে কয়টি বাঘ মেপেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চামড়াটি ছিল ন’ফুট তিন ইঞ্চি। বাকি পুরুষগুলোর আট ফুট হওয়াই দায়! ছবিতে যে বাঘের দৈর্ঘ্য মাপছি দেখতে পাচ্ছেন, এটি ছিল আট ফিট তিন ইঞ্চি।সেকালের শিকারিদের মধ্যে বাঘ মাপার দুটি স্বীকৃত পদ্ধতি ছিল—’বিটুইন দ্য পেগস’ ও ‘ওভার দ্য কার্ভ’। দুটি মাপের মধ্যে ইঞ্চি তিন-চারের কমবেশি হতো।
কী বিপদ! কার কাছে থেকে সত্যটা জানতে পারি! নানা শিকারির কাছে খোঁজ করা শুরু করলাম। কারও কাছেই সদুত্তর পেলাম না।
অবশেষে পরিচিত হলাম সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ বোটম্যান ও বাঘ শিকারি জব্বার মোল্লার সঙ্গে। মোল্লাকে চেপে ধরতে আসল কথা বের হয়ে এল।
মোল্লার স্বীকারোক্তি—সেকালে বাঘ শিকারিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল, কে কত বড় বাঘ শিকার করতে পারে। এটা অবশ্য ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা ছিল না। শিকারীরা মনে মনে পোষণ করতেন।
বাঘ মেরে চামড়া খসাতেন শিকারিরা। তার পর সেই কাঁচা চামড়া নাকে আর লেজে ধরে ‘দড়ি টানা’ শুরু করতেন। স্থিতিস্থাপক কাঁচা চামড়া টানের চোটে স্বাভাবিকের চেয়ে ফুট দেড়েক বড় হয়ে যেত। সেই বড় চামড়া দেখিয়েই শিকারিরা বড় বাঘ মারার কৃতিত্ব বগলদাবা করতেন।
একটি কথা বলা দরকার। একসময় আমরা জেনেছি সাইবেরিয়ান বাঘই সবচেয়ে দীর্ঘ। এখন দেখা যাচ্ছে ভারতের উঁচু এলাকায় থাকা বেঙ্গল টাইগার গায়ে-পায়ে সাইবেরিয়ান বাঘের চেয়ে কম না।
আজকাল দশ ফুটের উপর সাইবেরিয়ান বাঘও দেখা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ভাঞার পর মাৎস্যন্যায়ে বিপুল পরিমাণে সাইবেরিয়ান বাঘ মারা হয়। বাঘের জঙ্গলগুলি ‘আইসোলেটেড পকেট’ হয়ে যায়। এতে ‘জিন পুল’ সীমিত হয়ে যায়। বড় বাঘ আর মিলছে না।
এই হলো সুন্দবনের বাঘের দৈর্ঘ্যের ইতিবৃত্ত।