সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় ঠাকুরগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হলো আদিবাসী ওড়াঁও সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব কারাম পূজা। বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে নাচ–গান, ঢাক–ঢোল আর বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব মুখরিত হয়ে ওঠে সদর উপজেলার সালন্দর পাঁচপীরডাঙ্গা গ্রামে।
প্রতি বছরের মতো এবারও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলা শাখার আয়োজনে পালিত হয়েছে এই উৎসব। প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে আদিকাল থেকেই ওড়াঁওরা উপবাস থেকে শুরু করে কারাম বৃক্ষের ডাল পুঁতে পূজা–অর্চনা করে আসছেন। পূজা শেষে নারী–পুরুষ, শিশু–কিশোররা ঢাক–ঢোলের তালে নেচে–গেয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন।
আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, ভাদ্র মাসের শেষ দিন ও আশ্বিনের প্রথম দিনে পালিত কারাম পূজা বিপদ–আপদ থেকে মুক্তি, ভালো ফসল উৎপাদন ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে। ভাদ্র মাসের শেষ রাত ও আশ্বিনের শুরুতে ওড়াঁও নর–নারী সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রথম দিন উপোস রাখেন। উপোসের মধ্য দিয়েই পূজা শুরু করেন নারীরা। পরদিন সন্ধ্যায় মাদল, ঢোল, করতাল ও ঝুমকির তালে নেচে–গেয়ে এলাকা থেকে কারামগাছের (খিল কদম) ডাল সংগ্রহ করেন তারা। এরপর একটি পূজার বেদি নির্মাণ করে সূর্য পশ্চিমে হেলে গেলে সেই কারামগাছের ডালটি বেদিতে রোপণ করা হয়। এরপর ঢাক–ঢোলের তালে হাত–পা দুলিয়ে নেচে–গেয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন আদিবাসীরা। নাচ, গান আর গল্প বলার মধ্য দিয়ে জমে ওঠে উৎসবের আসর।
রঙিন পোশাকে সারিবদ্ধ হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন নারী–পুরুষ। ছোট–বড় সব বয়সী মানুষের পদচারণায় কারাম উৎসব রূপ নেয় মিলনমেলায়। শুধু ওড়াঁওরা নন, হিন্দু–মুসলিমসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষও যোগ দেন এই উৎসবে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কষাধ্যক্ষ বনি কেরকেটা বলেন, “বিপদ–আপদ থেকে মুক্তি, ভালো ফসল আর সুখ–সমৃদ্ধির আশায় আমরা প্রতিবছর এই পূজা পালন করি।”
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী বলেন, “কারাম উৎসব ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের অন্যতম উদাহরণ। সরকারি সহযোগিতা পেলে এটি আরও বড় আয়োজনে পালিত হতে পারে।”
উৎসব উপভোগ করতে স্থানীয়দের পাশাপাশি অন্য জেলা থেকেও ছুটে আসেন অসংখ্য মানুষ। ঢাক–ঢোলের শব্দ আর নাচ–গানে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা বলেন, প্রতিবছরই এই আয়োজনে আসতে তাদের ভালো লাগে।
তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের শুরু হয় ১৬ সেপ্টেম্বর। পূজা–অর্চনা শেষে ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে কারাম বৃক্ষের ডাল নদীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়েই সমাপ্ত হবে এবারের কারাম পূজা।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, “ওড়াঁও সম্প্রদায়ের এই সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে টিকে থাকুক, এজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।”
শুধু ধর্মীয় আচার নয়—কারাম উৎসব হয়ে উঠেছে সুখ–শান্তি কামনার পাশাপাশি সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের প্রতীক। এই ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মকে তাদের শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করায়, তেমনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মেলবন্ধন ঘটায়।
এসময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মো. খাইরুল ইসলাম। এছাড়াও সালন্দর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলে ইলাহি মুকুট চৌধুরী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী, ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি গোলাম মাওলা চৌধুরীসহ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
মঈনুদ্দীন তালুকদার হিমেল/দীপ্ত নিউজ