দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণ তিস্তা নদী এখন মৃতপ্রায়। একসময় স্রোতস্বিনী এই নদী আজ ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় থমকে গেছে কৃষি ও সেচ কার্যক্রম।
এক সময়ের খরস্রোতা এ নদী এখন বছরের অধিকাংশ সময় শুকনো থাকে। বর্ষায় ভাসে, আবার শীতে পরিণত হয় মরুভূমির মতো ফেটে যাওয়া বালুচরে। নদীভাঙন, চর গঠন ও তীব্র পানিসংকটে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা ও দুর্ভোগ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ দিনে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ গড়ে ছিল মাত্র ১৭ হাজার কিউসেক, যা স্বাভাবিক প্রবাহের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। নদীর গভীরতা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে, শুকিয়ে যাচ্ছে তলদেশ ও নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর।
তাই তিস্তা ব্যারেজের ওপর নির্ভরশীল উত্তরাঞ্চলের কৃষি এখন হুমকির মুখে। মাঠে ধান, ভুট্টা, পাট, তিলসহ নানা ফসল অপরিপক্ক অবস্থায় শুকিয়ে যাচ্ছে রোদে। পানি না থাকায় আসন্ন রবি মৌসুমে সেচ কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি কমে যাচ্ছে। নদী পুনঃখনন ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। রংপুরের নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ সতর্ক করে বলেন, বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা পুনঃখনন না হলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে।
তিস্তায় ভিন্ন চিত্র আবার ধরা দেয় বর্ষাকালে। ভারত থেকে নেমে আসা ঢালের পানিতে উছলে যায় তিস্তা। তখন তীব্র স্রোতে নদীভাঙনে হাজার হাজার বসতবাড়ি পানিতে ভেসে যায়। তলিয়ে অসংখ্য গবাদি পশু–পাখি।
পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে তিস্তা নদীর ভাঙনে ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নদীর তীরঘেঁষে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। রাজারহাট, গঙ্গাচড়া ও উলিপুরে শতাধিক ঘরবাড়ি হারিয়েছে মানুষ। লালমনিরহাটের মহিপুরে তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধের ৩৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ‘তিস্তা বাঁচাও, উত্তরবঙ্গ বাঁচাও’ স্লোগানে রংপুর বিভাগের নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা এই পাঁচ জেলায় চলছে আন্দোলন। স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীরা নদী রক্ষায় মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।
তারা জানান, তিস্তা এখন শুধু একটি নদী নয়, এটি উত্তরবঙ্গের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতীক। নদীটি মরে গেলে হারাবে কৃষি, হারাবে জীবন।
এদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হবে। ১২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে চীন দেবে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা।