জিশান হাসান
বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে পারত। সৌভাগ্যবশত, শেষ পর্যন্ত এই হার কমিয়ে ১০ শতাংশে আনা হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে সহনীয়। এই বিপুল পরিমাণ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব মূলত একটি সরলীকৃত এবং অর্থনৈতিকভাবে ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছিল—যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রাখে, তারা যেন আমেরিকানদের ঠকাচ্ছে।
বাংলাদেশ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বজায় রেখেছে, তবে এর মানে হলো, গড়পড়তা আমেরিকান নাগরিকরা বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের মতো স্বল্প মজুরির চাকরিতে আগ্রহী নন, আর গড়পড়তা বাংলাদেশিরা টেসলা গাড়ির মতো দামি পণ্য কেনার সামর্থ্য রাখে না।
তবে এটা ভাবার সুযোগ নেই যে, আমরা বিপদমুক্ত। আগামী চার বছর এই ধরনের অপ্রত্যাশিত ও হঠাৎ নেওয়া নীতির মুখোমুখি হতে পারে। তাই বাংলাদেশকে এখনই সাবধানতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্তৃপক্ষের নজরে পড়তে না হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হলো— যুক্তরাষ্ট্রের মেধাস্বত্বসম্পন্ন সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করা।
বাংলাদেশে সফটওয়্যার পাইরেসি দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রচলিত ব্যাপার। দেশে প্রায় প্রতিটি কম্পিউটার বিক্রির দোকানই গ্রাহকদের ‘ফ্রি’ সেবা হিসেবে পাইরেটেড মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ও এমএস অফিস ইনস্টল করে দেয়। একইভাবে অ্যাডোবি ক্রিয়েটিভ সুইট (যেমন) সফটওয়্যারও অবাধে পাইরেটেড হয়। দোকানপাটে পাইরেটেড সফটওয়্যারের ডিভিডিও বিক্রি হয়।
এগুলো মূলত মাইক্রোসফট ও অ্যাডোবির মতো মার্কিন কোম্পানির মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন করছে, যাদের স্বার্থ রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। একটি সাধারণ গুগল সার্চ থেকেই দেখা যায়—এমএস অফিসের লাইসেন্স প্রতি বছরে ১২৯ ডলার, আর অ্যাডোবি ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর ও প্রিমিয়ার প্রো মিলে বছরে ৮২৮ ডলার খরচ হয় একটি কম্পিউটারের জন্য। অর্থাৎ, বাংলাদেশে প্রতিটি কম্পিউটারে পাইরেটেড সফটওয়্যারের বার্ষিক মূল্য প্রায় ১ হাজার ৫৭ ডলার। দেশের মিলিয়ন মিলিয়ন কম্পিউটারে এই পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন হয়। এই ‘অপরিশোধিত সফটওয়্যার দায়’ যে কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্র চাইলে বাংলাদেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তাই সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করা এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রবেশাধিকার রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সফটওয়্যার পাইরেসি অনেক পুরোনো সমস্যা। আগে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এসব দেশে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কম দেখে এড়িয়ে যেত। কিন্তু বাংলাদেশ শিগগিরই এলডিসি মর্যাদা থেকে বেরিয়ে আসছে, ফলে এখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রের নজরে পড়ে যাচ্ছি। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন যখন বারবার কাল্পনিক অজুহাতে শুল্ক আরোপ করছে, তখন এ ধরনের ঝুঁকি একেবারেই অবহেলা করার মতো নয়।
আসলে, বাংলাদেশ কপিরাইট আইনে পাইরেটেড সফটওয়্যার বিক্রি করা অপরাধ হিসেবে গণ্য এবং এটিকে বন্ধ করাও অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাইরেটেড সফটওয়্যার যেমন মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ও অফিস – এসবের বিকল্প হিসেবে সম্পূর্ণ ফ্রি ও ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্স মিন্ট (www.linuxmint.com) এবং অফিস সফটওয়্যার লিব্রে অফিস (www.libreoffice.org) ব্যবহার করা যেতে পারে।
একইভাবে অ্যাডোবি ফটোশপের বিকল্প গিম্প (www.gimp.org), ইলাস্ট্রেটরের বিকল্প ওইনক স্পেস (www.inkscape.org ) এবং প্রিমিয়ার প্রোয়ের বিকল্প KDEnlive (www.kdenlive.org) ব্যবহার করা যেতে পারে।
এই পরিবর্তনগুলো ইতিমধ্যেই কাজী ফার্মস ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান দীপ্ত টিভি এবং করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) আওতায় পরিচালিত সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির প্রায় ১ হাজার ৫০০ কম্পিউটারে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে চাইলে কয়েক মাসের মধ্যেই দেশ জুড়ে সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করা সম্ভব।
মূল বাধা হচ্ছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে ফ্রি/ওপেন সোর্স সফটওয়্যার চালাতে পারে, এমন প্রশিক্ষিত আইটি কর্মীর অভাব। তবে এই সমস্যা দূর করা কঠিন নয়। ঢাকায় এখন অনেক লিনাক্স সার্টিফিকেশন কোর্স চালু আছে। তাই সব সরকারি ও বেসরকারি আইটি কর্মীর জন্য এই প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরাই পরে তাদের অফিসে পাইরেটেড সফটওয়্যারের পরিবর্তে ওপেন সোর্স সফটওয়্যার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন।
মাইক্রোসফট ও অ্যাডোবির মতো বিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানিগুলো তাদের সফটওয়্যারের জনপ্রিয়তা বাড়াতে বিশাল বিজ্ঞাপন বাজেট ব্যবহার করে। কিন্তু লিনাক্স বা ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের তেমন বাজেট নেই—তারা মূলত মুখে মুখেই জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় অনেক অলাভজনক সংগঠন গড়ে উঠেছে; যেমন—ফ্রি সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন (www.fsf.org), এফএসএফ ইউরোপ, এফএসএফ ইন্ডিয়া, ওপেন সোর্স ফাউন্ডেশন অব পাকিস্তান, লঙ্কা সফটওয়্যার ফাউন্ডেশন ইত্যাদি, যারা ওপেন সোর্স সফটওয়্যার জনপ্রিয় করতে কাজ করে। বাংলাদেশেও একটি এরকম সংগঠন গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করা এখন জরুরি জাতীয় প্রয়োজন। সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কপিরাইট আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে অচিরেই এই সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রের নজরে পড়বে, আর তখন এর খেসারত দিতে হবে আমদানি- রপ্তানিতে শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে।
লেখক: পরিচালক, কাজী ফার্মস