আয়েশা সিদ্দিকা শেলী: নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে ক্যান্সার , সেটি ব্রেস্ট ক্যান্সার । চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি এবং নব উদ্ভাবন সত্ত্বেও স্তন ক্যান্সারে নারী মৃত্যুহার সারা পৃথিবী ব্যাপী এখনো সবচেয়ে বেশী। ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রধান লক্ষন স্তনের কোনও অংশে ফোলা বা লালচে ভাব কিম্বা শক্ত পিন্ড আঁকার যা হাতে টের পাওয়া যায়। এছাড়া বগলের নীচে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে যাকে অক্সিলারি সোয়েলিং বলা হয়। এই লাম্পে সাধারণত কোন ব্যথা হয়না যে কারনে নারীরা প্রথম দিকে বুঝতে পারেনা এবং গুরুত্ব দেয়না। এই ক্যান্সার নির্নয় করা হয় মুলত ম্যামোগ্রাম বা বায়োপসির মাধ্যমে। সারা পৃথিবীতে এমনকি আমাদের দেশেও ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসার অগ্রগতি হয়েছে অনেক । যার ফলে রোগ নির্নয় হয়েছে সহজ, তৈরী হয়েছে নির্দিষ্ট এবং কম ক্ষতিকর চিকিৎসা পদ্ধতি । সাধারণত ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা সময় সাপেক্ষ। তবে বর্তমানে যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তা হলো প্রাথমিক সনাক্তকরন । প্রাথমিক সনাক্তকরণের ফলে স্টেজ এক কিম্বা দুই এ এটি ধরা পড়লে মাল্টিমোডালিটি চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা ৯০% । যা এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি ব্রেকথ্রু বলা যেতেই পারে।
চিকিৎসা পদ্ধতি –
সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি এবং প্রয়োজনে হরমোন থেরাপি এই চারটিই মুলত এই রোগের চিকিৎসা । সার্জারি দুই ধরনের –
ম্যাসটেকটমি -এবং লামপেকটমি বা ব্রেস্ট কনজারভেটিভ সার্জারি । যদি ম্যামোগ্রাফি এবং বায়োপসি করে দেখা যায় টিউমার স্তনের একটি অংশে সীমাবদ্ধ তখন পুরো স্তন বাদ দেবার প্রয়োজন পড়েনা। স্তন বাচিয়ে অপারেশন করার নামই হচ্ছে ব্রেস্ট কনজারভেশন সার্জারি বা লামপেকটমি। অন্যথায় পুরোটাই বাদ দিতে হয় যা ম্যাসটেকটমি। সার্জারির পরে বায়োপসি রিপোর্ট এর মাধ্যমে ক্যান্সারের ধরন , স্টেজ , রোগীর ফিটনেস ইত্যাদির উপর নির্ভর করে চিকিৎসকরা রেডিওথেরাপি , কেমোথেরাপি কিম্বা হরমোন থেরাপির সিদ্ধান্ত নেন। চিকিৎসা পদ্ধতি গুলি নির্ভর করে কার কতটা চিকিৎসা প্রয়োজন তার উপর । কারও এই চারটেরই প্রয়োজন পড়ে আবার কারো দুটো বা তিনটে লাগতে পারে।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন এই ক্যান্সার কি সম্পুর্ণ নিরাময় সম্ভব ? বর্তমানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর হার পাঁচবছর সারভাইভাল রেট দিয়ে ধরা হয়। অর্থাৎ রোগীর ক্যান্সার ধরা পড়ার বা চিকিৎসা শুরু হবার পাঁচ বছর পর কতজন রোগী বেঁচে রয়েছেন । ব্রেস্ট ক্যান্সার যদি শুধুমাত্র স্তনেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে ৯৯% রোগীর পাঁচ বছর সারভাইভাল রেট সম্ভব। অর্থাৎ প্রথম দিকে সনাক্ত হলে নিরাময় হবার সম্ভাবনা বেশী। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষপট ভিন্ন। সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ রোগীরা স্টেজ তিন কিম্বা চার এ চিকিৎসকের কাছে যান ফলে এখানে সারভাইভাল রেট ৫৯% হয়ে থাকে।
নিয়মিত চেকআপের গুরুত্ব :-
ব্রেস্ট ক্যান্সার নিরাময় হলেও রিল্যাপ্স করার আশংকা থাকে । তাই সম্পুর্ণ চিকিৎসা নেবার পরও প্রয়োজন নিয়মিত চেকআপ । সাধারণত চিকিৎসার তিন বছরের মধ্যে এই আশংকা বেশী থাকে আর হরমোন নেগেটিভ রোগীদের সম্ভাবনা থাকে আরো বেশী। সেইজন্য প্রথম দু বছরে একবার ম্যানেগ্রাম ও তিনমাস অন্তর ক্লিনিকাল পরীক্ষা করাতে হবে এবং পরবর্তী দু বছর ছয়মাস পরপর ক্লিনিকাল পরীক্ষা করতে হবে । চেকআপের সময় মেডিক্যাল হিস্ট্রি এবং যাদের হরমোন থেরাপি চলে তাদের বোন ডেনসিটি পরীক্ষা করাতে হবে।
ব্রেস্ট রিকন্স্ট্রাকশন :
ম্যাসটেকটমি করে পুরোটা কিম্বা লামপেকটমি করে স্তনের কিছুটা অংশ বাদ দেয়া হলে পরে সীর্জারির মাধ্যমে ব্রেস্ট পুনর্গঠন করা সম্ভব । এ চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল । তাছাড়া ক্যান্সার কতটা বিস্তার লাভ করেছিল রোগী , আর্থিক , শারিরীক ও মানসিক ভাবে এ অপারেশনের জন্য তৈরী কিনা ইত্যাদি অনেক কিছু বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে বয়সও একটি বিষয়।
রোগীর পুনর্বাসন:-
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির সমীক্ষায় বলা হয়েছে সঠিক চিকিৎসা হলে অধিকাংশ রোগীই পাঁচ বছর পর্যন্ত বাঁচেন।আমেরিকা , ইউরোপের দেশ সমুহ , কানাডা , অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্টেজে রোগ ধরা পড়ে সচেতনতা এবং একটি বয়সের পর ম্যামোগ্রাম বাধ্যতামূলক করার কারনে । ট্রিটমেেন্ট শুরু হয় যথা নিয়ম্।কিন্তু আমাদের মত দেশ গুলির চিত্র ভিন্ন যা আগেই বলা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার প্রভাব কিম্বা চিকিৎসা পরবর্তী যে সমস্যা বা পরিনতি এটি নিয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চাননা। আমাদের দেশের অধিকাংশ রোগী নিরব থাকায় নতুন আক্রান্ত যারা তারা কোন অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে পায়না। তাই এই দুরুহ পথে সকল নারীর নতুন পথ চলা শুরু হয় । চিকিৎসার ফলে যে শারিরীক সমস্যা হয় তা জানা প্রয়োজন । অনেকের ক্ষেত্রেই আর্ম সোয়েলিং হয় । লিমনোডস কাটার ফলে হাত ফুলে যেতে পারে । তবে সঠিক এক্সারসাইজ , ব্যান্ডেজ, ডাক্তারের চিকিৎসা এসবের মিলিত প্রয়াসে এটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
কেমোথেরাপির কারনে ত্বক কালো হতে পারে , চুল পড়া , নখ ভেঙ্গে যেতে পারে যা পরবর্তীতে সঠিক ডায়েট এবং শরীর চর্চার ফলে ঠিক হয়ে যেতে পারে।
হরমোনাল সমস্যা যেমন হঠাৎ গরম লাগা , সেক্সুয়াল সমস্যা , স্বামীর সংগে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে অনীহা ইত্যাদি। এটিও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। এক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং সংগীর ভুমিকা গুরুত্বপুর্ন।
রেডিওথেরাপির কারনে অপারেশনের জায়গা কালো দাগ কিম্বা বুকের উপরের ত্বক শক্ত হয়ে যেতে পারে । এটির ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরী ।
চিকিৎসা কি শুধু শরীরেই থাবা বাসায় ? মনের অসুখ কেউ দেখতে পায়না কিম্বা দেখতে চায়না। শরীরের অন্য অংশে ক্যান্সার ধরা পড়লে নারীরা উদ্বিগ্ন হলেও বলতে সংকোচ বোধ করেননা। কিন্তু ব্রেস্ট ক্যান্সারে সামাজিক এই সংকোচ এখনো অনেকের মধ্যে বিরাজমান। সংসারে নারীই থাকে মুল চালিকা শক্তি । স্বামী সন্তান নিতেও দুশ্তিন্তায় থাকে তারা । সন্তান ছোট থাকলে চিন্তা বেশী করে । নারীত্ব নিয়েসংশয় আর অ্যাংজাইটি । ট্রিটমমেন্চ অনেক ব্যয়বহুল সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন হতে পারে । এই সব নিয়ে মানসিক চিন্তায় কম বয়সী নারীদের সেক্সচুয়াল আইডেন্টিটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কম বয়সী নারীদের দাম্পত্য সম্পর্কে সমস্যা তৈরী করে। এটা কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য হয় কিন্তু স্বামীরা এটিকে আমলে না নিয়ে ডিভোর্স পর্যন্ত দিয়ে দেয় কিম্বা অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তাই ব্রেস্ট ক্যান্সার ট্রিটমমেন্ট্র ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় ডক্তারকে সবকিছু জানানো। আমরা নারীরা অনেকসময় প্রশ্ন করতে সংকোচ বোধ করি । এক্ষেত্রে একটি কথাই বলার আছে কোন রকম সংকোচ রাখা উচিত নয় । কারন এই জীবনের যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত কিন্তু নারীর একার । তাই রোগ সম্পর্কে খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে হবে । আপনার ডাক্তারের কাছে প্রশ্ন করুন কোন দ্বিধা না রেখে। কম বয়সে যারা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তাদের ফার্টিলিটি নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাই সন্তান নেবার পরিকল্পনা করলে সতর্কভাবে এবং সঠিক পরিকল্পনা মত ক্যান্সার চিকিৎসা এবং জীবন যাপন করতে হবে। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে। ব্রেস্ট ক্যানসার হলে ভাল থাকার উপায় জানতে হবে এবং সুস্হ থাকার আপ্রান চেস্টা করতে হবে।
লেখক: আয়েশা সিদ্দিকা শেলী
অতিরিক্ত কর কমিশনার
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান উপদেস্টা
দি ব্লু স্কাই চ্যারিট্যাবল ফাউন্ডেশন