রানা প্লাজার ধ্বসকে বলা হয় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। হতাহতের দিক থেকে এই দুর্ঘটনা বৃহত্তম একটির তকমা, যা আমাদের কারও কাম্য ছিল না। আগামী দিনেও এ ধরনের তকমা কখনই চাই না। তাজরিন ফ্যাশানের অগ্নিকান্ডের রাতের আগুন দেখেছি, ভয়াবহতাও দেখেছি। তবে, সে রাতের আগুনে একটি মৃত দেহেরও খবর ছড়ায় নি। মৃত দেহ বের হয়েছে পরদিন ভোরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর। যেভাবে আমরা মৃতদেহের সংখ্যা গুনেছি ১,৭,১৩,১৯………………. অর্থাৎ কয়েকগুন করে প্রতি মূহুর্তে বেড়েছে মৃত দেহ বের করার সংখ্যা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সহকর্মীরা এই বিভীষিকা দিনের স্বাক্ষী। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর এই আগুনে পুড়েছে ১১৭ জন পোশাকশ্রমিক আর আহত হয় ২০০ জনের অধিক। তাজরিনের গল্প আরেক দিন হবে।
আজ বলবো আমার দেখা ধ্বসে যাওয়া রানা প্লাজা:
তাজরিন ফ্যাশানের মত বড় দুর্ঘটনার ছয়মাসও হয়নি। ২৪ এপ্রিল ২০১৩, রাজনৈতিক ইস্যুতে বিরোধী দলের হরতাল চলছে। একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিকতা করছি। হরতালের দিনগুলোতে রিপোর্টিং টিমকে দুই ভাগে ভাগ করে হরতাল ডিউটি দেয়া হয়। সকালে ছয়টা থেকে একটি গ্রুপের ডিউটি শুরু হয়। আর দুপুর দুইটা ডিউটি শুরু করে আরেক গ্রুপ। আমার ডিউটি ছিল বিকেলে। কিন্তু স্বভাব সুলভ ভাবে সকালে ঘুম থেকে উঠৈ টিভি দিলাম। হরতালে ঢাকার বিভিন্ন স্পট আর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাইভ হয়। এখানে বলে রাখি এই সময়টিতে ঝটিকা মিছিল হতো সকালের দিকে। এসময় নাশকতার ঘটনাও ঘটতো। সেরকম লাইভ চলতেই দেখা, নয়টার দিকে সংবাদ ভিত্তিক চ্যানেলে ব্রেকিং, “সাভারের রানা প্লাজায় ধ্বস।” শুরুতে হতাহতের বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তবে, হতাহত বহু হবে এমন শঙ্কা রয়েছে।
আগের রাতে একুশে টেলিভিশন একটা সংবাদ করে। সেখানে দেখানো হয় সাভারে একটি ভবনের পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। নয়তলা ভবনের পাঁচটি ফ্লোরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টারি আরও আছে শপিংমল। আগের দিনই স্থানীয় প্রশাসনের কয়কজন কর্মকর্তা ভবনটি পরিদর্শন করেন। তখন তারা সাফাই গেয়ে বলেন, এই ভবনে কোন সমস্যা নেই। পরদিন সকালে ফ্যাক্টারিগুলো খোলার পরই ধ্বস !
অফিস থেকে চিফ রিপোর্টারের ফোন, অফিসে যেতে হবে এক্ষুণি। অফিসে গিয়েই যাত্রা শুরু সাভার। আগেই কয়েকটিম সেখানে অবস্থান নিয়েছে। সঙ্গে যোগ দিলাম আমিও। সামনে দাঁড়াতে মনে হল একটা “কংক্রিট স্যান্ডউইচ“। ভেতরে মানুষ আর তাদের চিৎকারে ভারী আশপাশ। মূল সড়কের পাশে ভবটির অবস্থান থাকায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে যান চলাচল। শুরুতে সরকারী বাহিনী উদ্ধারে যারা এসেছেন তাদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। তাই সেচ্ছাসেবী হিসেবে উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন স্থানীয়রা।
উদ্ধার কর্ম:
আমার সাধারণ মানুষ যারা উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন, তাদের না আছে নিজেদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম, না আছে উদ্ধার সামগ্রী। ভবনের উপরে কয়েকজন উঠে গেছেন। তারা নিজেরাই বড় হাতুরি, শাবল, লোহার রড দিয়ে কংক্রিট ফাঁকা করে হতাহতদের বের করছে। একটি বিষয় খেয়াল করলাম। হতাহতের উদ্ধারের পর ভাঙা ভবনের উপর থেকে নামাতে আধুনিক কোন সরঞ্জাম বা ট্রেসার নেই। ভাঙা ভবনের ভেতর থেকেই বড় থান কাপড় পাওয়া গেল। সেগুলো একপাশ ধরা হল ভাঙা ভবনের উপরে আর নীচে আরেক অংশ। উদ্ধার হওয়া জীবিত বা মৃত দেহ ওই থান কাপড়ে ছেড়ে দেয়া হয়, নীচে থেকে তা অন্যরা ধরে নেয়। উদ্ধারের পরে গন্তব্য হাসপাতাল। সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স। বিকট হুইসাল বাজিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে হাসপাতলে। রোগী নামিয়ে দিয়েই আবার ঘুরে আসছে রানা প্লাজায়। শুনেছি রানা প্লাজায় উদ্ধারে কাজ করা স্বেচ্ছা সেবীদের মত অ্যাম্বুলেন্সগুলো সেবা দিয়েছিল স্বেচ্ছায়।
কিছু সময়ের মধ্যেই খবর এলো হাসপাতালে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। এখানে মূল ভরসা ছিল সাভারের এনাম মেডিকেল। এই প্রতিষ্ঠাগুলোর নাম ব্যবহারের কারণ, পৃথিবীর দ্বিতীয় শিল্প দুর্ঘটনায় সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার সবটুকু নিয়ে। ফায়ার সার্ভিসের পর উদ্ধারে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সাভার সিএমএইচ, ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল, কোথায় নেই রানা প্লাজার দূর্ঘটনার শিকার রোগীরা?
সংবাদকর্মীরা একে অন্যের ফোনে একটু খবর নিয়ে নিজের অবস্থান জানিয়ে নিশ্চিত করছেন সে সুস্থ আছে। সবার চোখই ভিজে যাচ্ছে আহতদের চিৎকারে। হতাহতদের স্বজনরা দিকবিদিক ছুটছে প্রিয় মুখের খোঁজে। অসহায় এই মানুষগুলোকে তখন খুব আপনজন মনে হচ্ছে। সংবাদ সংগ্রহ করছি, কিছুটা থেমে যাচ্ছি, নিজের হাতে চোখ মুছেছি। ভিডিও জার্নালিস্টের কাধে হাত দিয়ে উঠে আবার ছুটছি।
উদ্ধারকারী বাহিনীগুলাের মধ্যে সিদ্ধান্ত হল ঘটনাস্থলে উদ্ধার হওয়া মরদেহ নেয়া হবে শতবর্ষী অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। এবার শুরু হল লাশের সারি গোনা। সেদিন সন্ধ্যায় রানা প্লাজার সামনের সড়কের সড়ক বাতি জ্বলছে কি না, মনে নেই। তবে, সারি সারি অ্যাম্বুলেন্সের আলোর কারণে সেদিন সড়কের আশপাশের রং বিপদের চিহ্ন লাল আর বেদনার রং নীলের ছটায় জ্বলছিল।
ঘটনাক্রম:
এ ঘটনায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেন। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল একদিনের জাতীয় শোক পালন করা হয়।
এ ঘটনার পর উত্তেজিত পোশাক শ্রমিকরা দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবীতে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যপক আন্দোলন, গাড়ি ও বিভিন্ন ভবনে ভাংচুর চালায়। বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো এই ঘটনায় দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবীতে ২ মে সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করলেও পরবর্তিতে তা বাতিল ঘোষণা করে।
২৫ শে এপ্রিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন ও ঐ ভবনের গার্মেন্টস মালিকদেরকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। এই দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে সরকারিভাবে আলাদা কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় দায়ীদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশও দেন।
২৭শে এপ্রিল এই ভবনের দুটি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া সাভার পৌরসভার দুজন প্রকৌশলীকেও গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়। ২৮শে এপ্রিল এই ঘটনায় দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানাকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র্যাব গ্রেপ্তার করে।
এ সময়গুলোতেও চলছিল উদ্ধার কাজ। মনে আছে, দুর্ঘটনার তৃতীয় দিন। সঙ্গে ছিল সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট রউফ। খুব সাহসী মানুষ রউফ। আমাকে নিয়ে ভাঙা ভবনের পাশের ভবন দিয়ে উপরে উঠে গেল। সেটাও ঝুকিপূর্ণ আগেই জানিয়ে দিলেন সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারীরা। উপরে উঠে বিভিন্ন তলার ভাঁজে ভাঁজে আটকে থাকা মরদেহের ছবি নিচ্ছি। কারও হাত এসে গায়ে লাগছে। কোন কোন মৃতদেহের চোখ এতবড় হয়ে আছে যে, মনে হলো আমাকে জেরা করছে। আমি কিছুটা ভয় পেয়েই রউফকে বের হয়ে আসতে বলি। হ্যা, সত্যিই এতাে মরদেহের বিকৃত চেহারা দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পাই।
উদ্ধারের পরিকল্পনার ধীরগতি ও শুরুতে ভারী সরঞ্জাম উদ্ধার কাজে ব্যবহার না করার অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। হামলা করে বসেন উদ্ধারকর্মীদের উপর। সেখানে পুলিশকে সামাল দিতে এলাকাটি পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। এরমাঝেই আমাদের আশ্রয় নেয়া পাশের ভবনে হঠাৎ করেই ঝাকুনি দিয়ে উঠে। এবার প্রাণ ভয়ে নিচে ছুটতে গিয়ে পড়ে গেলাম ভবনের সিঁড়ির সামনে। আমার উপর পড়ল রউফ। এবার শত মানুষের পায়ের নিচে। শুধু মনে আছে, পাশ থেকে একজন আমার ছড়িয়ে থাকা হাত ধরে টেনে উঠালো। উঠে ধুলা মাটি মাখা নিজের পোশাক আর চেহারা নিজেই চিনতে পারছিলাম না।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি থাকি রানা প্লাজা এলাকায়। একদিন রাত তিনটায় বাসায় ফিরে গোসল করার সময় সহধর্মীনিকে বললাম, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। আর একনাগারে কথা বলতে থাকলাম। মানুষ ভয় পেলে যা হয়, আরকি।
ফলোআপ:
সরকারী তথ্য মতে, এ দূর্ঘটনায় ১১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়।
এরপর আসামী ধরা থেকে শুরু করে বিচার শুরু তবে, সুফল মেলে না। বছর বছর ভুক্তভোগীদের ইন্টারভিউ করি। আমি একে একে তিন প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছি। রানা প্লাজা ধ্বসেরও চলছে এগারো বছর। এখনও অসহায় মানুষেরা বলে, ‘বিচার চাই, সরকারের সহায়তা চাই‘। বছরের পর বছর আমরা (আমি ও আমার সহকর্মীরা) এই স্টোরি করি। যা এখনও চলমান।
বেশ কয়েক বছর ঢাকা জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন আব্দুল মান্নান সাহেব। উনার কক্ষে একটি টিনের বাক্স ছিল। যার উপর লেখা ‘রানা প্লাজা‘। আমাদের ছাত্র জীবনে হলে ব্যবহার করা বাক্সের আকার। সেটিতে একটি তালাও ঝুলতো। তার কক্ষে থেকে এই বাক্সের ছবি নিলাম। সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলাম। তবে, মাথায় গেথে গেল এই বাক্স। এই বাক্সের মধ্যে আছে রানা প্লাজার মামলার তদন্তের অনেক কাগজ। স্টোরি করলাম, ‘বাক্সবন্দি রানা প্লাজার মামলা‘।
এগারো বছর পর আজ লিখছি রানা প্লাজা নিয়ে। অনেক দিনের ঘটনা মনে আছে। অনেক মানুষের জীবন পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে, এগারো বছরে বিচারকার্যটি খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ সব এগিয়েছে শুধু বিচারের জায়গাটি থমকে গেছে। তবে ভুক্তভোগি কেউই ভুলবে না সেদিনটি। ঐ শিশুটি ভুলবে না তার বাবা–মাকে হারানোর দিনটি।
এর জবাব কি???
লেখক: আসিফ জামান সুমিত
সিনিয়র ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, দীপ্ত টেলিভিশন
এজে/দীপ্ত সংবাদ