ঘন কুয়াশায় ও তীব্র ঠান্ডায় দেশের উত্তরাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দিনেরবেলায় গাড়ির লাইট সচল রেখে চলাচল করছে যানবাহন। খেটে–খাওয়া পরিবার, আবাল বৃদ্ধ–বনিতা ও ছিন্নমূল মানুষ খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের স্বল্পস্থায়ী সমাধানের বৃথা চেষ্টা করছেন।
নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে শীতের তীব্রতা এতটা প্রকট যেন মনে হয় বরফের তীর কাপড় ভেদ করে শরীরে বিঁধছে বিষের মত। বেলা গড়াতেই শুরু হয় ঘন কুয়াশাপাত। দৃষ্টিসীমা সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তুষারের সৃষ্ট দেওয়ালের দুই তিন ফুটের মধ্যে। সবচেয়ে কষ্টে আছেন প্রৌঢ় মানুষ। শীতের কারণে রোগ–শোকে কাতরাচ্ছেন শিশু ও বয়স্ক মানুষ।
রংপুর বিভাগের চরাঞ্চলের ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের কষ্ট যেন সীমাহীন। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার ও ধরলা নদী তীরবর্তী চার শতাধিক চরাঞ্চলে বসবাসকারীদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।গাইবান্ধায় গত তিনদিনে সূর্য মামার দেখা মেলেনি। শীতের ভয়াবহ তীব্রতার হাত থেকে রেহাই দিতে কিছু উষ্ণ পোশাক নিয়ে সমাজের অন্য মামারাও এগিয়ে আসেনি লালচামার– কাপাশিয়া নদী রক্ষা বাঁধের নীচে ছোট্র কুটিরে বসবাসরত একমাত্র পুত্র বিয়োগে শোকার্ত ও তীব্র শীতে জুবুথুবু শুকনি বেওয়ার পাশে।
রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারি, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড়ের আকাশে দিনের অনির্ধারিত কোন এক সময়ে সূর্যের আলো একটু–আধটু দেখা দিলেও তাতে নেই তাপপ্রবাহ। ঠান্ডা বাতাসের কারনে চাষীরা আলুর খেতে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। নিম্ম আয়ের মানুষ উপার্জন করতে পারছেন না। উষ্ণ পেশাক এবং খাদ্য সহায়তা উভয়ই প্রয়োজন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। বেলা একটা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় রোড–ঘাট পরিষ্কার দেখা যায় না। এর ফলে তীব্র শীতে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্মে ভাঁটা পড়ায় রাস্তাঘাটে চলাচলকারী নেই বললেই চলে।“এ্যাংকো চলিলে বাপু, হামার পেট চলিবেনি, না খায়া থাকিবা হবে“বলছিলেন ঠাকুরগাঁও শুখানপুকুরীতে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমান দরিদ্র অটোচালক নুরুন্নবী মিয়া।
শুষ্ক মৌসুমে তীব্র তাপদাহে এ অঞ্চলের মানুষকে যেমন পুড়তে হয়, বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানিতে তলিয়ে যেতে হয়, তেমনি শীতকালে তীব্র শৈত্যপ্রবাহে তাদেরকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়। এর যেন কোন শেষ নেই।নেই কোন টেকসই সমাধান। ভৌগোলিক অবস্থিতিজনিত কারণে এবং সরকারি সদিচ্ছার অভাবে বিষয়টিকে শুধুই একটি অবধারিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে রংপুর বিভাগের মানুষ মেনে নিলেও কষ্ট লাঘবে পর্যাপ্ত মানবিক উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না।এ যেন এক অবশ্যম্ভাবী বিধির বিধান! এই তো আগামী ৬০–৭০ দিনের মাথায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলাসহ উত্তরবঙ্গের সবগুলো নদী শুকিয়ে উষর–মরু ভূমিতে পরিণত হবে চরাঞ্চলের চাষাবাদ যোগ্য জমি।ফলে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসবে আরেক ধরনের বিপর্যয়।উত্তরবঙ্গের মানুষের নিয়তিতে প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে যোগ হয় বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দূর্যোগ। কিন্তু এ অঞ্চলের মানুষের শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষার বৈরিতা মোকাবিলায় সরকারি প্রস্তুতি, সরকারি সহায়তা এবং সামাজিক উদ্যোগের অপর্যাপ্ততার কারণে প্রতি বছরই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে যে অসহনীয় দুর্দশায় পড়তে হয় তা অবর্ননীয়।
“আমরা উত্তরাঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে পঞ্চগড়– ঠাকুরগাঁয়ের মানুষ হিমালয় পর্বতের অনেকটা কাছাকাছি বসবাস করি বিধায় শীতকালে প্রচণ্ড শীত ও শৈত্য প্রবাহের মুখোমুখি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করি। সেজন্য নিম্ন আয়ের অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য উষ্ণ পোশাক নিয়ে পাশে দাঁড়ানো উচিত“। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগে গরম কাপড়ের ত্রাণ সামগ্রীর যথাযথ বিতরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এমনটি বলেন–পঞ্চগড়ের পাঁচপীর ইউনিয়ন ভূমি উপ–সহকারী কর্মকর্তা মুর্শিদা হাসান।
প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘনঘটা আবহমানকাল থেকেই এ জনপদের মানুষ মোকাবেলা করে আসছে তবে মনুষ্যসৃষ্ট দূর্যোগ যেমন তিস্তা জায়ান্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য নদনদীর গতিপথ সচলের স্থায়ী সমাধানে কার্যকর এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বিগত সময়ে। ফলে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। শুষ্ক ও বর্ষাকালীন দূর্যোগ তথা বন্যা এবং খরার প্রকোপ থেকে রেহাই পেলে উত্তরাঞ্চলের জনগণের আর্থ–সামাজিক ভীত মজবুত হবে।চাষাবাদ করে সচ্ছল হতে পারবে হাজারো পরিবার। গ্রামে–গঞ্জে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর বৃদ্ধি পাবে। ফলে শীতকালে ঘন কুয়াশা এবং শৈত্যপ্রবাহ মোকাবেলায় নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও উষ্ণ পোশাকের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারবে।এজন্য সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
আল