গ্রাহকদের শতকোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে ভারতে জেল খেটে দেশে ফেরা সাতক্ষীরায় প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো–অপারেটিভ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক প্রাণনাথ দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
শুক্রবার (২৮ জুন) রাতে তাকে পুরাতন সাতক্ষীরার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত প্রাণনাথ দাস(৪৬) সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার টিকেট গ্রামের মৃত জুড়ন দাসের ছেলে ও বর্তমাসে পুরাতন সাতক্ষীরার বাসিন্দা।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিদুল ইসলাম জানান, প্রতারণার অভিযোগ থাকা প্রাণনাথ দাস ভারত থেকে এসে গোপনে বাড়িতে অবস্থান করছে জানতে পেরে শুক্রবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২২ জন গ্রাহকের পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা প্রতারণার অভিযোগে শহরের কাটিয়া কর্মকারপাড়ার কালিপদ গাইনের ছেলে প্রমান্ত কুমার গাইন বাদি হয়ে শনিবার বিকেলে থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় প্রাণনাথ দাস, তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস, বড় ভাই বিশ্বনাথ দাস ও ভায়রা ভাই পুরাতন সাতক্ষীরার প্রদীপ কুমার দাসকে আসামী করা হয়েছে। প্রাণনাথকে রবিবার আদালতে তোলা হবে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়,প্রাণনাথ দাস ২০০২ সালে রুপালী লাইফ ইনসিওরেন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জেলা ও জেলার বাইরে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে বহু টাকা আত্মসাৎ করেন। পরে ২০১২ সালে ১২১ নং সমবায় রেজিষ্ট্রেশন মূলে প্রগতি সঞ্চয় ও ঋণদান কো–অপারেটিভ সোসাইটি খোলেন প্রাণনাথ দাশ। সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বড় ভাই বিশ্বনাথ দাশকে নিযুক্ত করে গত ১০ বছরে ডিপিএস ও ফিক্সড ডিপোজিট এর মাধ্যমে কয়েক শত গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা প্রতারণা করেন। প্রতারণার টাকা দিয়ে তিনি পুরাতন সাতক্ষীরায় বাড়িসহ গাভায় চার বিঘা জমি, সদুরডাঙিতে দুটি বাড়ি, বুধহাটায় দুটি অফিস, মুন্সিপাড়ায় চার শতক জমি ও পুরাতন সাতক্ষীরায় দুটি শোরুম খোলেন। জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে প্রাণনাথ সাতক্ষীরা মন্দির সমিতির সাংগঠণিক সম্পাদক, বাস মলিক সমিতির সাংগঠণিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন সংগঠণের ভাল ভাল পদ অলঙ্কৃত করেন। করেন কুলিয়া ইউপি নির্বাচন। একপর্যায়ে প্রাণনাথ টিকেট গ্রামে নিজের পৈতৃক ১১ বিঘা জমি, মুন্সিপাড়ার চার শতক জমি, গাভার জমিসহ সদুরডাঙার একটি বাড়ি, কুল্ল্যার দুটি অফিস বিক্রি করে দেন। বিক্রি করেন তার কয়েকটি বাস ও প্রাইভেটকার। সদুরডাঙির একটি বাড়ি ও পুরাতন সাতক্ষীরার বাড়ি প্রাইম ব্যাংক সাতক্ষীরা শাখা থেকে এক কোটি ১৩ লাখ টাকার ঋণ নেওয়ায় তা আর হস্তান্তর হয়নি। এসব জমি বিক্রি করার খবর পেয়ে গ্রাহকরা মুনাফা ও আসল টাকা ফেরৎ চাইলে প্রাননাথ টালবাহানা শুরু করেন।
এসব টাকা ফিরে পেতে তারা প্রশাসনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের শরনাপন্ন হয়েও কোন প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভ‚ধর সরকারসহ শতাধিক ব্যক্তি চলতি বছরের ১৮ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, র্যাব– ৬ ও পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে প্রাননাথ দাশ, তার ভাই বিশ্বনাথ দাশ ও স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস যাতে গ্রাহকদের বিপুল পরিমান টাকা বিদেশে পাঠিয়ে নিজেরা পালাতে না পারে সেজন্য তাদের পাসপোর্ট জব্দ করার আবেদন করা হয়।
এরপরও কতিপয় গ্রাহক টাকা পাওয়ার দাবিতে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর প্রাণনাথের বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ চলাকালে প্রাণনাথ দাশ অজ্ঞাত স্থানে থেকে উত্তর রাজারবাগানের আসাদুজ্জামান তুহিনের মাধ্যমে আন্দোলনকারিদের হুমকি দেন। ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে প্রাণনাথের স্ত্রী ও মেয়ে শ্যামনগর উপজেলার ভেটখালি গ্রামের প্রাননাথ দাসের দক্ষিনহস্ত কৃষ্ণপদ মন্ডলের ছেলে মিলন মন্ডল, প্রাণনাথ দাসের ভায়রা ভাই যশোর জেলার কোতোয়ালি থানার ডহরসিংগা গ্রামের নির্মল কুমার দাশের ছেলে মিঠুন কুমার দাশ, আসাদুজ্জামান তুহিনসহ কয়েকজনের সহযোগিতায় বাড়ি থেকে বের হয়ে একটি ইজিবাইকে উঠে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন।
প্রাণনাথের স্বপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ার খবরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পক্ষ থেকে ২১ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়। বিকেল চারটায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক অরুন কুমার কর্মকার বাদি হয়ে প্রাণনাথ, স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস ও বড় ভাই বিশ্বনাথ দাশ এর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন। তবে মিলন মন্ডলের ভগ্নিপতি মানিকখালির বিশ্বজিৎ মন্ডল জানান, বোন রীতার(বিশ্বনাথের স্ত্রী) মাধ্যমে মিলন তাকে প্রগতি সংস্থায় অধিক লাভে ১২ লাখ টাকা জমা দিতে বলে তাকে প্রতারণা করেছে। তিনি এখন পথের ফকির।
স্থানীয়রা জানান, প্রাণনাথ জনরোষে পড়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিক থেকে মিলন মন্ডলের পরামর্শে নতুনঘেরি এলাকায় থাকতো। মিলনের সহযোগিতায় প্রাণনাথ হরিনগর বাজারের এক বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা গুগল পে বা ফোন পে এর মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়েছে। স্ত্রী ও মেয়েকে মিলনের সহযোগতিায় ২০ ডিসেম্বর নতুৃনঘেরীতে আনার পরদিন প্রাণনাথ দাস রমজাননগরের সীমান্তবর্তী কালিন্দি নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার দমদম এলাকার নিউটাউনের বাড়িতে চলে যান। প্রাণনাথের আত্মসাৎ করা বড় অংকের টাকার একটি অংশ ও বিভিন্ন মালামাল মিলন আত্মসাৎ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তণ করেছে। চলতি বছরের ১১ মার্চ থেকে প্রাণনাথকে খুঁজে না পাওয়ায় অবৈধপথে দেশত্যাগ করা তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস গোবরডাঙা থানায় মিসিং জিডি করেন।
এদিকে পরষ্পর যোগসাজসে আট জনের কাছ থেকে ২৪ লাখেরও বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আশাশুনি উপজেলার পাইথলি গ্রামের অসিত দাসের ছেলে নীলমনি দাস গত ২৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরার আমলী আদালত–৮ এ প্রাণনাথ দাস, তার স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাসসহ ১০জনের নামে মামলা করেন। পিবিআই তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পাওয়ার পর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম জিয়ারুল ইসলাম প্রাণনাথ দাস ও তার স্ত্রী ইতি বিশ্বাসের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেয়।
গত ১৭ মার্চ প্রাণনাথকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার গোবরডাঙা থানাধীন জামদানি গ্রামের একটি বাািড় থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। প্রাণনাথের গ্রেপ্তারের খবর আকাশ বানী কোলকাতা, ডিডি–১ টেলিভিশন ও আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়। অবৈধপথে ভারতে আসার অভিযোগে পুলিশ বাদি হয়ে প্রাণনাথের বিরুদ্ধে ফরেনার এক্ট ১৪(এ) ধারায় একটি মামলা(জিআর–৭৮/২৪) দায়ের করেন। ১৮ মার্চ তাকে বারাসাত সহকারি বিচারিক হাকিমের (এসিজেএম) আদালতে তোলা হয়। এর এক মাস না যেতেই প্রাণনাথের স্ত্রী ইতি রানী বিশ্বাস তার এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চোরাই পথে সাতক্ষীরায় ফিরে এক ফেইসবুকে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেন।
সাতক্ষীরা শহরের কাটিয়া কর্মকার পাড়ার প্রমান্ত কুমার গাইন জানান, আদালতে দোষ স্বীকার করায় দমদম সেন্ট্রাল জেলে তিন মাস কারাভোগ শেষে গত ৬ জুন বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাকে বাংলাদেশে পুসব্যাক করে। এরপর থেকে প্রাণনাথ বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে ছিল। শুক্রবার রাত ১১ টার দিকে পুরাতন সাতক্ষীরার বাড়ি থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
আল/ দীপ্ত সংবাদ