দীর্ঘ ৯মাস রক্তক্ষয়ী ও বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা–বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাঙালি জাতি বিজয় লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় দিবস উল্লাস হলেও নওগাঁয় পালন করতে পারেনি দেশের সোনার ছেলেরা। দেশ স্বাধীনের দুই দিন পর ১৮ ডিসেম্বর নওগাঁকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এদিন প্রায় দুই হাজার পাকিস্থানি সেনা নওগাঁর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর শুরু হয় বিজয়উল্লাস।
২৫ মার্চ কালো রাতে পাকবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু করে। এই দিনে পাক হানাদারদের আক্রমণের শিকার হয় নওগাঁ। যার ফলে ২৬ মার্চেই নওগাঁ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার শপথ গ্রহণ করে।
২৫ মার্চে ঢাকাসহ দেশের বহু এলাকা পাক হানাদারদের আক্রমণের শিকার হলেও নওগাঁ মুক্ত ছিল প্রায় এক মাস। ২১ এপ্রিল দুপূর ১২টার দিকে বিনা বাধায় হানাদার বাহিনী নওগাঁয় প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে।
২২ এপ্রিল পাকবাহিনীর অপর একটি কনভয় ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজশাহী থেকে সড়ক পথে নওগাঁয় প্রবেশ করে। তাদের নির্দেশ মতো ঐদিন রাতে পাকিস্থান রক্ষার লক্ষে শান্তি কমিটি গঠন করে। ২২এপ্রিল নওগাঁ পাক হানাদারদের দখলে চলে যায়। প্রায় সাড়ে ৭ মাস ধরে পাক হানাদার বাহিনীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালায়।
১০ডিসেম্বর জেলার রাণীনগর উপজেলা এবং ১২ ডিসেম্বর পার্শ্ববর্তী বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহার হানাদার মুক্ত হয়। ফলে পার–নওগাঁয় বসবাসকারী সকল অবাঙালিরা ১৪ ডিসেম্বর রাতের মধ্যে স্বপরিবারে নওগাঁ কেডি স্কুলে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নেয়। এ সময় হানাদার বাহিনী নওগাঁ ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, সাবেক থানা চত্বর, আদালত পাড়া ও এসডিও বাসভবন চত্বরে আত্মরক্ষামূলক প্রতিরক্ষা বেষ্টনী গড়ে তোলে।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্থান সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। এ খবর শোনার পর জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নওগাঁকে মুক্ত করার প্রস্তুতি নেন মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার জালাল হোসেন চৌধুরী। সে অনুযায়ী ১৭ ডিসেম্বর, শীতের সকাল ৭টার দিকে প্রায় ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ শহরের দিকে অগ্রসর হতেই পাকিস্থানী সেনারা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। সকাল থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উভয় পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর ওই সাত শহীদের রক্তের বিনিময়ে নওগাঁ হানাদারমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর।
নওগাঁর বীরমুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাসে “জয় বাংলা জয় বাংলা ” ধ্বনি দিতে দিতে এসডিও অফিস চত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। সেই থেকে নওগাঁ হানাদার মুক্ত ১৮ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়। এ দিনটিকে ঘিরে জেলার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নওগাঁ হানাদার মুক্ত দিবস পালন করে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও একুশে পষিদের নওগাঁর সাধারণ সম্পাদক এম এম রাসেল মুঠোফোনে বলেন, বাঙ্গালী জাতীর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা নওগাঁবাসী হানাদার মুক্ত হয়েছি বিজয়ের দুইদিন পর ১৮ ডিসেম্বর। তিনি সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী ও বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা–বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাঙালী জাতি বিজয় লাভ করে।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্থানি সেনারা ঢাকায় আত্মসমর্পণের খবর শুনার পর থেকেই বীরমুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাসের জন্য নওগাঁ শহরে প্রবেশের চেষ্টা করে। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৭ টার দিকে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ৩–৪শত মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জগৎসিংহপুর, খলিশাকুড়ি, হাট–নওগাঁ, শিবপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে পাকিস্থানি সেনারা মার্টার সেল নিক্ষেপ করে। শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ৭ জন শহীদ হন। সেদিন যাঁরা শহিদ হয়েছেলেন কিশোর অছিমুদ্দিন, ফজলু, ফরিদ হোসেন, আমজাদ হোসেন, ওসমান, শাহাদাত হোসেন, ইসাহাক। পর দিন ১৮ই ডিসেম্বর সকালে বগুড়া থেকে অগ্রসরমান ভারতীয় মেজর চন্দ্র শেখর, পশ্চিম দিনাজপুর বালুরঘাট থেকে পিবি রায়ের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী নওগাঁ শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্থানি সেনাদের তখন আর করার কিছুই ছিল না। ফলে সকাল ১০ টার দিকে প্রায় দুই হাজার পাকিস্থানি সেনা নওগাঁ কেডি স্কুল ও পিএম গার্লস স্কুল থেকে শুরু করে পুরাতন থানা চত্বর এবং এসডিও অফিস থেকে শুরু করে রাস্তার দুপাশে মাটিতে অস্ত্র রেখে সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে নত মস্তকে আত্মসমর্পণ করে। পুরাতন কালেক্টর (এসডিও) অফিস চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সেখানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা পতাকার প্রতি সালাম জানিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। নওগাঁ হানাদার মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। এরপর থেকে দিনটিকে স্বরণীয় করে রাখতে একুশে পরিষদ নওগাঁ বেশ’ক বছর যাবৎ ধারাবাহিক ভাবে দিবসটি উদযাপন করে যাচ্ছে। তাই নওগাঁ মুক্ত দিবসের সকল কর্মসূচিতে আপনাদের অংশগ্রহণ কামনা করছি বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: আজ ২৫ এপ্রিল নওগাঁর গণহত্যা দিবস
জেলার সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি ডি এম আবদুল বারী বলেন, প্রতিবছর এ দিনটিকে ‘নওগাঁ হানাদার মুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করেন তারা।
নওগাঁ জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কামান্ডের সাবেক কমান্ড হারুন–অল–রশিদ মুঠোফোনে বলেন, সারাদেশে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় উল্লাস হলেও নওগাঁ বাসী হানাদার মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। তাই প্রতিবছর ‘নওগাঁ হানাদার মুক্ত’ পালন করা হলে নতুন প্রজন্মরা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবেন। দিবসটি চিরস্মরণীয় করার জন্য সরকারিভাবে পালন করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
আব্দুর রউফ রিপন/মোরশেদ/দীপ্ত নিউজ