সোমবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৫
সোমবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৫

অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন ২০২৫ অনুষ্ঠিত

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

অনুপ্রাণন লেখক সম্মেলন ২০২৫ (দ্বিতীয় পর্ব) অনুষ্ঠিত হয়েছে গত শনিবারে (২২ নভেম্বর)। নবীনপ্রবীণ লেখকদের মিলনমেলা বসে রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরস্থ কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। শিল্পসাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণনএর মোড়ক উন্মোচন, অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে সদ্য প্রকাশিত ৪টি বইয়ের পাঠ মূল্যায়ন ও অনুপ্রাণন পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা ২০২৫এ বিজয়ী অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী ১০ জন তরুণ লেখক ও কবির হাতে পুরস্কার ও উপহার তুলে দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে গান পরিবেশন করে কিরণ সংস্কৃতি সদনের খুদে সদস্যরা। তারা সূচনা সংগীত হিসেবে পরিবেশন করে ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি/ শুষ্ক হৃদয়ও লয়ে আছি দাঁড়ায়ে’ ও ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনাসুরমা নদীতটে/ আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়’ গান দুটি।

স্বাগত বক্তব্যে অনুপ্রাণন সম্পাদক ও প্রকাশক আবু এম ইউসুফ বলেন, ‘২০১২ সালে ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন যাত্রা শুরু করে। ম্যাগাজিনটি নিয়মিভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথম ১০ বছরে আমরা নিয়মিত আয়োজনে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আলোচনা, সমালোচনা ইত্যাদি প্রকাশ করেছি। একাদশ বর্ষে এসে আমরা চিন্তা করি বিশেষ কিছু করার।’

বিগত প্রায় চার বছরে বাংলাদেশের নির্বাচিত ১০০ জন গল্পকার, বাংলাদেশের ১০০ কবি ও কবিতা, এরপর সাম্প্রতিকের কবিতা ও সাম্প্রতিকের গল্পসংখ্যা প্রকাশ করার বিষয়ে আলোকপাত করেন তিনি। আবু এম ইউসুফ পূর্বাপর ব্যাখ্যা করে আরও বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্যের বিশেষ ব্যক্তিদের একটা জায়গায় এনে তাদের সম্বন্ধে জানানো। নতুন প্লাটফর্মে জড়ো করা। সংখ্যাগুলোতে তরুণরা লিখেছে। এর মাধ্যমে অগ্রজ কবি ও গল্পকারদের সম্বন্ধে তরুণদের পড়াশোনার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুপ্রাণনের মূল উদ্দেশ্য শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতির রুচি সৃষ্টি করা। আমরা সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি।’

এরপর শিল্পসাহিত্যের ত্রৈমাসিক অনুপ্রাণন সাম্প্রতিকের গল্পকার ও গল্পসংখ্যা দ্বিতীয় পর্বের মোড়ক উন্মোচন করেন পাঁচজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক⸺ আকিমুন রহমান, আরিফ মঈনুদ্দীন, .. শামসুল আলম, মোজাম্মেল হক নিয়োগী ও মনি হায়দার।

মনি হায়দার তার বক্তব্যে বলেন, ‘বর্তমানে দেশ একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন শিল্পীত মন ও সংস্কৃতিচর্চা। শুভ’র পক্ষে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। জাগরণের একটি পথ করে দিয়েছে অনুপ্রাণন ও আবু এম ইউসুফ। এখন কেউ বই পড়ছে না, বই কিনছে না। এখানে অনুপ্রাণন পথ দেখাচ্ছে।’ এসময় অন্য প্রকাশকদেরও অনুপ্রাণন মডেল অনুসরণ করার আহ্বান জানান মনি হায়দার।

মোজাম্মেল হক নিয়োগী বলেন, ‘অনুপ্রাণনের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ অনেক মূল্যবান ও মর্যাদার উদ্যোগ। টাকা অনেকের কাছে আছে, সেই টাকা খরচ করার যথাযথ পথ কজনের জানা আছে! নবীন লেখকদের কাছ থেকে টাকা ছাড়া বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।’

আরিফ মঈনুদ্দীন বলেন, ‘লেখকদের খুঁজে বের করে তাদের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ সহজ কোনো কাজ নয়। জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সেই কথার আদলে আমি বলি, সবাই সংগঠক নয়, কেউ কেউ সংগঠন। অনুপ্রাণন সুসংগঠক হয়ে উঠছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কবিতা যারা পড়েন, কবিতা লেখেন, কবিতা শোনেন তারা প্রথম শ্রেণির সমঝদার। অনুপ্রাণন মেলবন্ধন সৃষ্টি করছে। এটা অব্যাহত থাকুক।’

আকিমুন রহমান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ তুলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু এম ইউসুফকে বিনম্র সম্মান জানান। তিনি বলেন, ‘এই মুক্তিযোদ্ধারা দেশ উদ্ধারপরবর্তী সময়ে যখন কাজ করবেন সেখানে পূর্ণ বিভায় উদ্ভাসিত হবেন⸺ সহজেই অনুমেয়। সেটাই আমরা দেখতে পেয়েছি আবু এম ইউসুফের মধ্যে। অগ্রজদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে লেখা হচ্ছে না বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেন। প্রতিষ্ঠিত লেখকরাও যেন নবীনদের নিয়ে লেখেন সেই চর্চাও থাকা উচিত। নবীনদের জন্য রাস্তা সৃষ্টি করা জরুরি। পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী তরুণদের সৌভাগ্যবান মনে করি।’ এসময় তিনি তরুণদের পড়ার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ দেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত অনুপ্রাণনের চারটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। কথাসাহিত্যিক নাসিমা আনিস রচিত গল্প সংকলন নির্বাচিত গল্প⸺ আলোচক ছিলেন মাইনুল ইসলাম মানিক। কবি ও প্রাবন্ধিক হাফিজ রশিদ খান রচিত কাব্যগ্রন্থ নারীস্থান ও পার্শ্ববর্তী চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেন সালেহ রনক। কথাসাহিত্যিক ইলিয়াস ফারুকী রচিত গল্পগ্রন্থ আগরবাতি ও মৃত্যুর গন্ধর আলোচক সরকার আবদুল মান্নান। কথাসাহিত্যিক উম্মে মুসলিমা রচিত কলাম সংকলন আমার কন্যা যেন থাকে নির্ভয়ে বইয়ের আলোচক ড. সাবিনা ইয়াসমিন।

মাইনুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘নাসিমা আনিস যাপিত জীবনের গল্প লেখেন। চারপাশের মানুষকে নিয়ে তার গল্পগুলো। প্রত্যেকটা গল্পের বিষয়বস্তু একটা থেকে আরেকটা আলাদা। কোনো মিল নেই। ভিন্ন আঙ্গিকের, নতুন ধারার। কোনো বাক্যে অলংকরণ, নীতিশাস্ত্র বা দর্শন নেই।’

সালেহ রনক বলেন, ‘হাফিজ রশিদ খানের নারীস্থান ও পার্শ্ববর্তী চিত্রকল্প কাব্যগ্রন্থে নারীর কথা উঠে এসেছে বারবার। কোনো কোনো কবিতায় ধরা দিয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিক্ষোভ। এই বইয়ে কবি এমন কিছু লিখেছেন যেখানে রয়েছে তার আত্মসমালোচনা ও দার্শনিকতা।’

সরকার আবদুল মান্নান বলেন, ‘ইলিয়াস ফারুকীর প্রত্যেক গল্প দুই থেকে তিন পাতা নয়, দুইতিন পৃষ্ঠা। সংক্ষিপ্ত গল্প। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আট/ দশ পৃষ্ঠার যে দীর্ঘ গল্পগুলো লিখেছেন সেটা এখন আর নেই। ইলিয়াস ফারুকীর প্রায় প্রতিটি গল্পেই রয়েছে প্রেম। মানবমানবী, তরুণতরুণীর প্রেম। এমনকি পরকীয়া প্রেমও আছে!’

. সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘উম্মে মুসলিমার দীর্ঘ বছরে রচিত কলামগুলো বইয়ে রূপ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমার কন্যা যেন থাকে নির্ভয়ে বইয়ে এমন কোনো বিষয় নেই যা আলোচিত নয়। লেখকের লেখা বিচিত্রধর্মী। তিনি মূলত নারীদের নিয়ে কাজ করেন। তবে উম্মে মুসলিমা যতটা নারীবাদী তারচেয়ে বেশি লিঙ্গ সমতাকামী।’

অনুপ্রাণন তরুণ পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা২০২৫ বিজয়ী ১০টি বই নিয়ে আলোচনা হয়। তিন ক্যাটাগরিতে রয়েছে⸺ কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। তরুণদের ৫টি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেন সরদার ফারুক। বইগুলো হচ্ছে : . আকিব শিকদার⸺ অক্ষরে আঁকা কণ্ঠস্বর, . আতিকুর রহমান হিমু⸺ হাসপাতালের বারান্দায়, . রাসেল মুহাম্মেদ খাইরুল⸺ সুন্দরের স্বপ্নদ্রষ্টা, . আইনাল হক⸺ সোনালী রোদ ও কুয়াশা দিন, . হিরণ্য হারুন⸺ বিভ্রান্ত যাদুকর। বাংলা কবিতা ও বিশ্বকবিতার নানাবিধ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরদার ফারুক বলেন, ‘বর্তমানে সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে সবচেয়ে উপেক্ষিত কবিতা। অথচ এখনো কবিতাই সর্বাধিক শক্তিশালী মাধ্যম। কবিতা কখনো গৌণ হয়ে যেতে পারে না। কবিতার নিজস্ব ভাষা আছে, এটা আমরা বহুকাল শুনেছি। কবিতা কীভাবে হয়ে ওঠে সেটা রহস্যময় ব্যাপার। কবিতার কোনো গন্তব্য নেই; সেটা মন পবনের নাও।’

তরুণদের ৩টি গল্পের বই নিয়ে আলোচনা করেন মামুন মুস্তাফা। বইগুলো হচ্ছে : . আহমাদ ইশতিয়াক⸺ আমাদের মহল্লায় বান্দর আগমনের ইতিহাস ও অন্যান্য গল্প, . আবদুল্লাহ্ আল বাকী⸺ পিওর মসগ্রীন, . সাখাওয়াত হোসেন⸺ বিভাবরী। ছোটগল্পের বিভিন্ন ব্যাখ্যার উপরে আলোকপাত করে তিনি বলেন, ‘এই তিন গল্পকার অধ্যবসায়ী হয়ে ছোটগল্পকে এগিয়ে নেবেন। তারা যেন পড়াটা অব্যাহত রাখেন।’ এসময় তিনি সাম্প্রতিক সম্ভাবনাময় কয়েকজন গল্পকারের নাম উল্লেখ করেন।

তরুণদের ২টি উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেন শেখ ফিরোজ আহমদ বাবু। বইগুলো হচ্ছে : . আতাউর রেজা পরশ⸺ নক্ষত্রের চোখে জল, . সারাবান তহুরা মৌমিতা⸺ তোমার চোখের জলে আমার জন্ম মা। শেখ ফিরোজ আহমদ বাবু বলেন, ‘মানুষ যখন লিখতে জানত না তখনো তার সৃজনশীল কল্পনা ছিল, বক্তব্য ছিল। বেঁচে থাকার স্বার্থে। কিছু উপন্যাস থাকে একরৈখিক, কিছু উপন্যাসে বহু কিছুর বিস্তার ঘটে।’ গল্পউপন্যাসের বিবর্তন নিয়ে বলার পাশাপাশি তিনি তরুণ ঔপন্যাসিকদের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতার দিকও উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে অনুপ্রাণন তরুণ পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সম্মাননা স্মারক, বই ও নগদ অর্থ উপহার প্রদান করা হয়। সম্মাননা স্মারক, বই ও নগদ অর্থ উপহার বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন প্রকাশকসহ বিশেষ অতিথিরা।

কিরণ সংস্কৃতি সদনের শিশুশিল্পীদের হাতে উপহার তুলে দেন প্রকাশক আবু এম ইউসুফ। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন রূপশ্রী চক্রবর্তী। তার সহযোগী ছিলেন শিখা আক্তার মিতা ও খাইরুন্নাহার তামান্না। সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালনা করেন ড. অনুপম কুমার পাল।

আরও পড়ুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More