গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসব কমিশন নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারের উপর কাজ করবে।
এই ছয় কমিশনের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ। (যদিও প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে এই কমিশনের প্রধান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের নাম ঘোষণা করেছিলেন, যা অন্য প্রসঙ্গ; সেদিকে যাচ্ছি না)।
কমিশন প্রধানদের নাম ঘোষণার এক সপ্তাহ পর, ১৯ সেপ্টেম্বর ৬ কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, কমিশনগুলো আগামী ডিসেম্বরে তাদের প্রতিবেদন দেবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, জাতির ভাগ্য নির্ধারণী এসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবনার কাজ ৩ মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত কম সময়ে আদৌ কি ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায়? সোজা উত্তর—না। এত অল্প সময়ে বা তড়িঘড়ি করে কিছু তৈরি হলে, তা ভালো হবে না। (যদিও মনে হতে পারে, সময় কম বলা মানে এই সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রছন্ন ইঙ্গিত; যা ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো মানতে চাইবে না। এক্ষেত্র আমি বর্তমানে জনপ্রিয় টার্ম—‘যৌক্তিক সময়‘ দেওয়ার পক্ষে।)
তাহলে কি আগে থেকেই সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো প্রস্তুত করা আছে? না–কি ধার বা আমদানি অথবা জোড়াতালি দিয়ে প্রণীত হবে সংস্কার প্রস্তাবনা প্রতিবেদন? আমদানি বা জোড়াতালি দিয়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সংস্কার হতে পারে, কিন্তু তা বোধ করি কারোই প্রত্যাশা নয়। এই পথে হাঁটলে মারাত্মক ভুল হবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদেশি মডেল ও ধারণা আমদানি করে দেশে গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে সংস্কার সাধনের চেষ্টা করলে, তা হবে ভয়াবহ।
যখন আমরা পশ্চিমা বা অন্য দেশের মডেল সরাসরি গ্রহণ করি এবং সেগুলোর প্রভাব অনুধাবন না করে তা বাস্তবায়নের দিকে ঝুঁকে পড়ি, তখন এই প্রচেষ্টা অনেক সময় স্বকীয়তার অভাবে ব্যর্থ হয়। কারণ প্রয়োজন ও বাস্তবতার সাথে সেই মডেলগুলোর সরাসরি সংযোগ থাকে না। স্থানীয় সমস্যাগুলোর গভীরে পৌঁছানোর চেষ্টা না করায়, বরং নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসেবে শিক্ষা খাতের কথা উল্লেখ করা যায়। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে চেয়েছি, কিন্তু তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বিদেশি কাঠামোতে সাজানো শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের শিক্ষার্থীদের আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানানসই নয়।
দেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা, আর্থ–সামাজিক অবস্থা, বাহান্ন ও একাত্তরের চেতনা, রাজনৈতিক অগ্রগতি ও অর্জন এবং ইতিহাস–ঐতিহ্য–সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি আমরা মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজতে পারি, তাহলে সেই সংস্কারগুলো হবে দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকর। কাজেই আমাদের রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিদেশি অনুকরণ বাদ দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে সংস্কার করা জরুরি।
এছাড়া, কমিশনগুলোতে অংশীজনের অন্তর্ভুক্তির রূপরেখার অনুপস্থিতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সংস্কার টেকসই করার ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণ প্রক্রিয়া কিভাবে হবে, তাদের ভূমিকা কী থাকবে—এসব বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে আর্থ–সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে। বিদেশি কিংবা পূর্বে প্রস্তুত করা সংস্কার মডেলের বাস্তবায়ন মাঠ প্রশাসনে কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না।
আমাদের অবশ্যই বিশ্ব থেকে শিক্ষা নিতে হবে, তবে সেই শিক্ষাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেশীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করতে হবে। উদ্ভাবন ও গবেষণার মাধ্যমে আমরা নিজস্ব মডেল তৈরি করতে পারি, যা আমাদের ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর সাথে খাপ খায়। দেশের সকল শ্রেণি–পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে, তাদের মতামত ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করা যেতে পারে, কিন্তু সরাসরি আমদানি নয়। রাষ্ট্রের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ক্ষেত্রে ‘আমাদের জন্য আমাদের পদ্ধতি‘ এই মন্ত্রটি মেনে চলতে হবে। দেশীয় পদ্ধতিতে সংস্কারই হবে সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। এজন্য সরকারের নীতি নির্ধারকদের এবং সাধারণ জনগণের সচেতনতা ও সহযোগিতা জরুরি।
আর একটি কথা, পরিবর্তিত বাংলাদেশে নতুন যে সদর্থক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জনপ্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে নাগরিকের মনন এবং আচরণেও সংস্কার আনা জরুরি। আমরা যদি আগের মতোই নিয়মভাঙ্গার সংস্কৃতির অনুশীলন করি, তাহলে রাষ্ট্রের আনীত সংস্কার বেশিদিন টেকসই হবে না। এতে জুলাইয়ের চেতনা ম্লান হয়ে যাবে।
লেখক:
মাসউদ বিন আবদুর রজ্জাক
নিউজ এডিটর ও অনলাইন ইনচার্জ
দীপ্ত টেলিভিশন
আল/ দীপ্ত সংবাদ