শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

বরফাচ্ছাদিত নাড্ডি

দীপ্ত নিউজ ডেস্ক
35 minutes read

মধ্যরাতে হঠাৎ সুপর্ণার ফোন। একটু অবাক হয়েই ফোনটা ধরলাম, “কিরে এত রাতে?”

ওপাশ থেকে সুপর্ণার গলা, “কাজ করছিস?”

একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “এটাই তো আমার কাজের সময়। কাজ না করে আর কি করবো।

শোন না! নেক্সট উইক weather forecast আছে হিমাচলে বরফ পড়বে। মানালি যাবি?”

ধুর! মানালি তো এখন ধর্মতলা হয়ে গেছে। পা রাখার জায়গা পাবি না।

তাহলে? কিন্নর যাবি?”

দেখ সুপর্ণা, বেশিদিন ছুটি পাব না। বুধবার বৃহস্পতিবার আমার week off। মঙ্গলবার আর শুক্রবার leave নিয়ে চারদিন ম্যানেজ করা যেতে পারে। কিন্তু তোর তো আবার শনি রবি off। মঙ্গল থেকে ছুটি নিতে পারবি তো?”

“No problem. I can manage. Tirthan যাবি?”

হবে না।

তাহলে?”

চল নাড্ডি ঘুরে আসি। চারদিনে হয়েও যাবে।

ওকে, তুই প্ল্যানটা সাজিয়ে নিয়ে আমাকে জানা। আমি মঙ্গল থেকে শুক্র ছুটির অ্যাপ্লাই করে দিচ্ছি।

সুপর্ণা মহীশূরে কাজ করে আর আমি হাওড়াতে নিজের বাড়ি থেকে work from home করছি। তাই ঠিক হলো সুপর্ণা ব্যাঙ্গালোর থেকে ফ্লাইটে দিল্লি আসবে আর আমি কলকাতা থেকে ফ্লাইটে দিল্লি যাবো। দিল্লি airport এ মিট করে আমরা একসঙ্গে নাড্ডি যাবো। সেই মতো টিকিট কাটা হলো আমাদের।

মঙ্গলবার সন্ধ্যে ৬ টার সময় আমি ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামলাম। সুপর্ণাকে ফোন করে জানলাম ও arrival main hall Odyssey Bookstore এ আছে। আমি বললাম বেরিয়েই বাঁদিকে ফরেক্সের একটা দোকান আছে, ওখানে দাঁড়া আমি স্যাকটা কনভেয়ার বেল্ট থেকে নিয়ে আসছি। সুপর্ণার সঙ্গে দেখা হতেই বলল,”কি ঠান্ডা রে! আমি তো রীতিমত কাঁপছি।

জানুয়ারি মাসে ঠান্ডা হবে না? জ্যাকেটটা পরে নে।

ছবি: সোমদীপ

আমরা মেট্রো স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেলাম। Ticket Issuing Machine থেকে নিউ দিল্লির দুটো টিকিট কেটে নিলাম। ভাড়া পড়লো ৬০ টাকা করে। নিউ দিল্লি আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ফাঁকা মেট্রো, হাতপা ছড়িয়ে যাওয়া যায়। নিউ দিল্লি থেকে yellow লাইন মেট্রো ধরে কাশ্মীরি গেট যাওয়া যায়। আমরা yellow লাইনের দিকে পা বাড়ালাম। দিক নির্দেশ করাই আছে, যেতে কোনো অসুবিধে হয় না। এখানে খুব ভিড়। লাগেজ নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে ট্রেনে উঠলাম। নিউ দিল্লি থেকে তিনটে স্টেশন কাশ্মীরি গেট। ভাড়া পড়লো ২০ টাকা। ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাশ্মীরি গেট। কাশ্মীরি গেট মেট্রো থেকে ISBT যাওয়ার আলাদা একটা গেট আছে। ওটা দিয়ে বেরোলে সোজা ISBT পৌঁছে যাওয়া যায়। নাহলে ভিড় রাস্তা পেরিয়ে যেতে খুব অসুবিধে হয়। মেট্রোতে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে ISBT যাওয়ার গেট। ISBT তে ঢুকে কাউন্টার #৯ এর দিকে এগিয়ে গেলাম। কাউন্টার #৯ হিমাচল রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের কাউন্টার। রাত ৮:৫০ এর ম্যাকলয়েডগঞ্জ যাওয়ার ভলভো/স্ক্যানিয়াতে দুটো টিকিট কাটলাম। আগে থেকে টিকিট করিনি কারণ শীতকালে দিল্লির ফ্লাইট খুব লেট করে। ফেরার টিকিটও করে নিলাম। যাতায়াতের ভাড়া পড়লো ২৮০০ একজনের। এখনো হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে। এস্ক্যালেটর দিয়ে নেমে নিচে বসার জায়গা। খুব ভালো ব্যবস্থা এই মহারানা প্রতাপ আন্তর্জাতিক বাস স্ট্যান্ডে। লেডিস জেন্টস সেপারেট ওয়াশরুম, ক্লোকরুম, খাবার দোকান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান সব এখানে পাবেন। প্ল্যাটফর্ম #৪০ থেকে সাধারণত ধর্মশালা যাওয়ার বাস ছাড়ে। আমরা প্ল্যাটফর্ম এ এসে দাঁড়ালাম। সাংঘাতিক ঠান্ডা জ্যাকেট, ইনার, গ্লাভস, কানঢাকা টুপি পরেও ঠকঠক করে কাঁপছি। মোবাইলে দেখাচ্ছে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যথাসময়ে বাস এলো। আমার স্যাক আর সুপর্ণার ব্যাগটাকে বাসের পেটে চালান করে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসে উঠে পড়লাম। বাসের ভেতরে টেম্পারেচার কন্ট্রোলড আছে তাই অনেকটা আরাম ভেতরে। ঠিক সময় বাস ছাড়ল। দিল্লির ট্রাফিক পেরিয়ে বাস NH-44 ধরলো। আস্তে আস্তে পানিপথ ও কর্নাল পেরিয়ে এলাম। কুরুক্ষেত্রের একটু আগে বাস একটা ধাবাতে ডিনারের জন্য দাঁড়ালো। ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২ টা। এখানে লেডিস জেন্টসের আলাদা ওয়াশরুম আছে। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আমরা ডাল মাখানি আর তন্দুরী রুটি অর্ডার দিলাম। খাবারের টেস্ট বেশ ভালো। ২৫০ টাকা আমাদের বিল হল দুজনের। বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো জ্বালাজিতে। ঘড়িতে দেখলাম ভোর ৬:৩০। এখানে জ্বালামুখী দেবীর মন্দির আছে। এটি হলো একান্ন সতীপীঠের একটি। কথিত আছে এখানে সতীর জিভ পতিত হয়। এখানে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকে দেবী রূপে পুজো করা হয়। এই আগুন সবসময় প্রাকৃতিক ভাবে জ্বলতে থাকে। 

ছবি: সোমদীপ

সকাল ৮ টার সময় ধর্মশালা পৌঁছলাম। ভলভো ধর্মশালা বাসস্ট্যান্ড অব্দি যাবে। এখান থেকে আমাদের অন্য একটা বাসে করে ম্যাকলয়েডগঞ্জ যেতে হবে কারণ ভলভো ম্যাকলয়েডগঞ্জ এর সরু রাস্তা দিয়ে যেতে পারবে না। ধর্মশালা বাসস্ট্যান্ডে আধ ঘণ্টা দাঁড়ানোর পর ধর্মশালা যাওয়ার বাস এলো। St. John in the Wilderness চার্চ ম্যাকলয়েডগঞ্জ যেতে পড়বে। ঠিক তার আগেই নাড্ডি যাওয়ার রাস্তা বাঁদিকে বেঁকে গেছে। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম একদম ম্যাকলয়েডগঞ্জ অব্দি চলে যাব কারণ St. John in the Wilderness থেকে নাড্ডি আরও ৩ কিমি। এতটা রাস্তা লাগেজ নিয়ে হাঁটা সম্ভবপর নয় আর ওই জায়গা থেকে কোনো কিছু পাব কিনা তারও নিশ্চয়তা কিছু নেই। ৯ টা নাগাদ আমরা ম্যাকলয়েডগঞ্জ পৌঁছলাম। ম্যাকলয়েডগঞ্জ অটোস্ট্যান্ড থেকে আমরা নাড্ডি যাওয়ার জন্য অটো নিলাম। ভাড়া পড়লো ৩০০ টাকা। অটোওয়ালা জিজ্ঞেস করলো কোন হোটেলে যাব। আমাদের কোনো হোটেল ঠিক করা নেই শুনে বলল ও একটা ভাল হোটেলে আমাদের নিয়ে যাবে।

অটো ঝাউবন ঘেরা পাকদন্ডী রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো। এত ঘন ঝাউবন যে আকাশ প্রায় দেখা যায় না।

এ যেন এক অপরূপ রূপবৈচিত্রের সম্ভার। দেবদারু গাছের জঙ্গল, পাহাড়, আকাশ, নিরবতা মিলেমিশে যেন একাকার এখানে। ১২ ঘণ্টা বাস জার্নি করেছি কিন্তু এখানে পৌঁছানোর পর সকল ক্লান্তি একনিমেষে উধাও হয়ে গেল এখানকার সৌন্দর্যে। বাঁদিকে পড়লো সেই চার্চ – St. John in the Wilderness। সত্যিই জনমানবহীন! পাখির কলকাকলি ছাড়া কোনো শব্দ নেই। অটোটাকে একটু দাঁড়াতে বললাম। জায়গাটা এতো আকর্ষণীয় যে আমরা ভেতরে না ঢুকে পারলাম না। দেবদারুর জঙ্গলের মধ্যে এই neo gothic architecture এর চার্চ দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এই নির্জন পরিবেশে বাঁদিকের কবরস্থানটা শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। লর্ড এলগিনকে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে এখানে সমাধিস্থ করা হয়।

সুপর্ণাকে বললাম, “ডিনার করে এখানে আসবি? রাতে দারুণ লাগবে।

হ্যাঁ তুই আসিস! আমার এখনই এখানে থাকতে ভয় করছে আর উনি আবার রাতে আসবেন।

পেছন থেকে অটোচালকটি আমাদের ডাকলো, “ম্যাডামজি জলদি কিজিয়ে। বর্ফবারি শুরু হোনে বালী হে।

সত্যি তো! এতক্ষণ খেয়াল করিনি, আকাশ যে একদম নিকষ কালো। দেবদারুর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মেঘ এসে আমাদের গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে অটোতে উঠলাম। সুপর্ণা উত্তেজনায় বলে উঠলো, “তাহলে snowfalls দেখা হবে, বল্?” অটো একটু এগিয়ে ডানদিকে নাড্ডির রাস্তা ধরলো। এখানে দুদিকে চিরহরিৎ বৃক্ষের ঘন জঙ্গল তারমধ্যে দিয়ে আমরা এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ওপরে উঠছি। একটু পরে ডানদিকে একটা সবুজ রঙের লেক পড়লো। অটোচালকটি বললো এটি ডাল লেক। এখানে বেশ কয়েকটি মন্দির আছে দেখলাম। ডাল লেক পেরোতেই সাবুদানার মতো বরফ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নিচের দিকে পড়তে লাগলো। সুপর্ণা চেঁচিয়ে উঠলো, “snowfalls! snowfalls!” অটো আমাদের Srishti Homestay তে নিয়ে গেল। অসাধারন লোকেশন এই home stay টার। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ধৌলাধার range দেখা যায়। Home stay এর মালিক সুরেশজি এগিয়ে এসে আমাদের greet করলো। দোতলায় ডবল বেড রুম ১৫০০ টাকা। আমার খুব পছন্দ হলো। সব রকম আধুনিক সুবিধেযুক্ত। রুমের সামনে বারান্দা। সুপর্ণাকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম ও জীবনের প্রথম snowfall এনজয় করছে হাতটা দুদিকে ছড়িয়ে মুখটা আকাশের দিকে তুলে চোখ বন্ধ করে পাক খেয়ে যাচ্ছে আর মুখটা বরফ পরে পুরো সাদা হয়ে যাচ্ছে। আমি হাসতে হাসতে ওকে ডেকে বললাম ওপরে এসে রুমটা দেখে কনফার্ম করে যা। সুপর্ণা চেঁচিয়ে বললো তোর পছন্দ হলেই হলো। আমি এখন snowfalls ছেড়ে কোথাও যাব না। 

ছবি: সোমদীপ

দুপুরে ভাত ডাল আলু গোবি আর ডিমের কারি দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। সুরেশজি নিজেই রান্না করেন, রান্নার হাতটিও চমৎকার। আর ব্যবহার তো খুবই অমায়িক। বললেন রাতে আপনাদের চিকেন খাওয়াবো। বেশ একটা homely পরিবেশ এখানে। মনে হয় যেন নিজের বাড়িতেই আছি। খেয়েদেয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। একটানা বরফ পরে চলেছে। লাগাতার তুষারপাতে সাদা চাদরে ঢেকে যাচ্ছে আস্তে আস্তে পুরো গ্রামটা। মোবাইলে দেখলাম মাইনাস টেম্পারেচার কিন্তু দিল্লিতে যেরকম শীত করছিল সেরকম কিন্তু এখানে করছে না। হয়তো সহ্য হয়ে গেছে। বিকেলবেলা সুপর্ণা আমার পাশে এসে বসলো।

বললো, “বেশ জোরে তুষারপাত হচ্ছে তো রে সোম। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।

হ্যাঁ। পুরো whiteout

সুরেশজি গরম গরম কফি আর চিকেন পকোড়া দিয়ে গেল। কফির মগে চুমুক দিয়ে সুপর্ণা আমাকে বললো, “কি অসাধারন দৃশ্য রে! পুরো হোয়াইট! আমি কল্পনাও করতে পারিনি এরকম কিছু একটা দেখবো। আমি এতদিন জানতাম এই দৃশ্য খালি ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় দেখতে পাওয়া যায়।

আমি একটা চিকেন পকোড়া মুখের মধ্যে চালান করে দিয়ে বললাম,”আমাদের দেশে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী আবার গুজরাট থেকে অরুণাচলে যা দেখার আছে তা সাতজন্ম ঘুরেও দেখে শেষ করতে পারবি না।

সত্যি সোম। আমি ভেবেছিলাম নেক্সট ইয়ার সুইজারল্যান্ড যাব। কিন্তু এখন ভাবছি আগে নিজের দেশটাকে তো ভালো করে দেখি। অ্যাই সোম!!! সব পকোড়াগুলোকে শেষ করে দিবি না। আমার জন্যে রাখবি।

তুই ডায়েটে আছিস না!?”

কে বললো তোকে?”

না, পকোড়াগুলোকে দেখে কেন যেন আমার মনে হলো!”

আমি snowfall এর দিকে concentrate করলাম।

রাতে চিকেন রুটি আর স্যালাড দিয়ে দারুণ ডিনার হলো। সুরেশজি কে জিজ্ঞেস করলাম বাইরে বেরোনো যাবে কি না। বললো বরফ পরা একটু কমলেই বেরোনো যাবে।

ছবি: সোমদীপ

সকালে উঠে দেখলাম বরফ তখনও পরে চলেছে কিন্তু তার তীব্রতা কমেছে। বাড়ির সামনে এক কোমর বরফ জমে গেছে। সুরেশজি একটা বেলচা দিয়ে বরফ সাফ করছে। আকাশ তখনও মেঘলা। আমরা ঠিক করলাম ব্রেকফাস্ট করে বেরোবে। আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরোলাম। সুপর্ণা দেখলাম একটা লাল ছাতা নিয়েছে। আমি আমার DSLR টা নিয়ে নিলাম। সুপর্ণার কাঁধে ওর Nikon D7500। চারদিক পুরো সাদা হয়ে আছে। সাদার যে এত মাধুর্য্য থাকতে পারে এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। গাড়িগুলো সব বরফে ঢেকে গেছে। কিছু টুরিস্ট বরফ ছোড়াছুড়ি করে নিজেদের মধ্যে খেলছে। গাছের ডালে বরফ জমে আছে আর ঝুপঝুপ করে মাঝে মাঝেই বরফ নিচে পড়ছে। সুপর্ণা একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। আমি একটা লাঠি দিয়ে গাছের একটা ডাল নাড়িয়ে দিলাম। ঝুরঝুর করে অনেকটা বরফ ওর গায়ে এসে পড়লো।

অ্যাই কি করছিস! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা!”

সুপর্ণা বরফ তুলে আমার দিকে ছুঁড়তে লাগলো। সমানে বরফ পড়ে চলেছে, তার মধ্যেই বরফ ভেঙে আমরা এগোচ্ছি। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। একটু হেঁটেই হাঁপিয়ে গেলাম। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। দুপ্লেট ম্যাগি অর্ডার দিলাম। দেখলাম দোকানের ছেলেটা ছাদে উঠে বেলচা দিয়ে বরফগুলো নিচে ফেলছে। এটা কেন করছে জিজ্ঞেস করাতে বললো বরফগুলো না ফেললে বরফের ভারে টিন ভেঙে যাবে। বললো আমাদের শীতকালে খুব কষ্ট জল জমে যায়, কোনো কাজকর্ম করা যায় না। সত্যি, একদুদিনের জন্য এখানে এসে মজা করা এক আর এই বরফের মধ্যে দিনের পর দিন থাকা আর এক। টিভিতে দেখতে এই বরফ বেশ ভালো লাগে কিন্তু নিত্যদিন এই বরফের মধ্যে থাকলেই বোঝা যাবে কত কষ্টকর এখানকার জীবনযাত্রা। আমরা ম্যাগি খেয়ে আবার এগোতে লাগলাম। রাস্তা ডাল লেকের দিকে চলে গেছে। গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তাটা পরিষ্কার করা হয়েছে। সুপর্ণাকে বললাম শক্ত বরফের ওপর পা দিস না পড়বি, নরম বরফে পা দিয়ে চল। কিন্তু ও তো আমি যা বলবো ঠিক তার উল্টোটা করবে। শক্ত বরফে পা দিয়ে আচার খেয়ে পড়ল। ওকে তুলবো কি, আমি হেসেই লুটোপুটি! এমনিতেই কোমরে লেগেছিল আমার হাসি দেখে আরও ক্ষেপে গেল। যাইহোক ওকে তুলে রাস্তার ধারে বসালাম। এখান থেকে নিচের পাকদন্ডী রাস্তাটা দারুণ দেখাচ্ছে। আমরা ডাল লেক পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। লেকের পাশের রাস্তাটা বরফের চাদরে ঢেকে আছে, তার পাশে সবুজ ডাল লেক আর লেকের পর থেকেই পাহাড়ের গায়ে সবুজ দেবদারু গাছের ডালে বরফ ঝুলছে কে বলে স্বর্গ শুধু কাশ্মীরে আছে! মাঝে মাঝে ঝুপ ঝুপ করে শব্দ হচ্ছে গাছের ডাল থেকে বরফ মাটিতে পড়ছে। সে এক স্বর্গীয় পরিবেশ!

দুপুরে বরফ পড়া থেমে গেল। আকাশটাও পরিস্কার হতে শুরু করেছে। কিন্তু ধৌলাধার দেখা যাচ্ছে না। চারদিকের পরিবেশ ভীষন শান্ত। এদিকে টুরিস্টের ভিড় নেই তাই ওদের হইচইও এখানে শোনা যাচ্ছে না। সুপর্ণা বললো, “কাল চলে যাব, মন খারাপ লাগছে রে। আর কিছুদিন থাকলে হতো, বল?”

ভালো কিছু ক্ষণিকেরই ঠিক আছি, দীর্ঘমেয়াদি হলেই সেটা আর ভালোলাগা থাকে না অভ্যেসে পরিণত হয়। দেখছিস না এখানকার লোকজন বরফ দেখে কেমন বিরক্ত হচ্ছে।

ভোরে উঠে দেখলাম আকাশ পরিষ্কার। তখনও আলো ফোটেনি। অন্ধকারে সামনের তুষারশুভ্র ধৌলাধারকে অসাধারণ লাগছে। আকাশে তখন সবে মৃদু মৃদু আলো ফুটছে। এখানে সানরাইজের থেকে সানসেট বেশি সুন্দর। তবু সানরাইজ দেখার জন্য আমরা বারান্দায় দাঁড়ালাম। অবশেষে পেছনের পাহাড় থেকে সূর্যদেব উঁকি মারলেন। সে যে কি অভূতপূর্ব দৃশ্য তা না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। একদিকে সূর্যের আলো আকাশ জুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আর অন্যদিকে ধৌলাধারে সূর্যের সোনালী রং লেগে মনে হচ্ছে গোটা পাহাড়টাকে কেউ যেন সোনা দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে।

আমাদের সন্ধ্যে ৬:৩০ টায় দিল্লির ভলভো। অটো দুপুরবেলা চলে এল আমাদের নিতে, ম্যাকলয়েডগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে আমাদের নামিয়ে দিল। এখানেও প্রচুর বরফ পড়েছে দেখলাম। আমাদের একটা non AC বাস ম্যাকলিয়ডগঞ্জ থেকে ধর্মশালা বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে এল। হিমালয়ের অমোঘ আকর্ষণ আমি কোনোদিনই ফেরাতে পারিনা আর এইসব ছোট ছোট গ্রামে যে কত ঐশ্বর্য্য লুকিয়ে আছে তা এখানে না এলে বোঝা যায় না। তাই বারবার ছুটে আসবো এইরকম ছোট্ট ছবির মতন সুন্দর পাহাড়ি গ্রামে।

ছবি: সোমদীপ

———–

কিভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে হিমগিরি এক্সপ্রেসে বা জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেসে পাঠানকোট ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন। পাঠানকোট থেকে বাসে ম্যাকলয়েডগঞ্জ। ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে অটোতে নাড্ডি। গাড়ি করেও পাঠানকোট থেকে সোজা নাড্ডি চলে আসতে পারেন। ছোট গাড়ির ভাড়া পড়বে ৩০০০ মতো।

কোথায় থাকবেন: থাকার প্রচুর হোটেল আছে। কয়েকটা হোটেলের নাম নিচে দিয়ে দিলাম:-

1.  Udechee Huts: Tariff 4500 per night. Ph: 9816032280.

2. Naddi Boutique Hotel: Tariff 1600 per night. Ph: 9736524445.

3. Om Hotel: Tariff 1000 per night. Ph: 8988018813.

4. Aliza Inn and Suites: Tariff 4000 per night. Ph: 8091168303

5. Srishti Homestay: Tariff 1500 per night. Ph: 9736058299.

কি দেখবেন: কাংরা, জ্বালামুখী, চিন্তপূর্ণি, পালামপুর, ধর্মশালা, ম্যাকলিয়ডগঞ্জ। আবার ডালহৌসী, খাজিয়ার, চাম্বা যোগ করে একটা বড় ট্যুরও করে নেওয়া যায়।

(সমাপ্ত)

লেখক: সোমদীপ
ভ্রমনপিপাসু ও ফটোগ্রাফার

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More