বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৬ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

বাঁধ ভাঙা আর মেরামতের বৃত্তে জীবন কাটছে ফেনীর নদীপাড়ের মানুষের

10 minutes read

মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে ফের দুর্গতিতে পড়েছেন ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার বাসিন্দারা। দীর্ঘ বছর ধরে বাঁধ ভাঙা আর মেরামতের বৃত্তে জীবন কাটছে তাদের।

গত সোমবার মুহুরী নদীর ফুলগাজী উপজেলার উত্তর বরইয়া ও উত্তর দৌলতপুর, পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম অলকা গ্রামে তিনটি স্থানে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। পাঁচ দিন ধরে প্রবাহিত বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি, সড়ক, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণীর ক্ষয় ক্ষতি বেড়েই চলেছে। পানি নামার সাথেই ভেসে উঠছে ক্ষত চিহ্ন।

ফেনী জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ফুলগাজী উপজেলার ১১৪৫টি পরিবারের ১৪ হাজার ৫০০ বাসিন্দা ও ১১৪৫টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় এই উপজেলার ৫৫০ হেক্টর রোপা আমন, ১৫ হেক্টর সবজি, সাড়ে ৪৪ হেক্টর আয়তনের ৩৫০টি পুকুরের ২৫ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া ৮৭টি হাঁস এবং ২০৯টি মুরগী মারা গেছে।

এদিকে পরশুরাম উপজেলার ৫৫০টি পরিবারের ২৬ হাজার বাসিন্দা ও ৫৫০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এসময় ১৬৫ হেক্টর রোপা আমন, ৫ হেক্টর সবজি, ৩০টি পুকুরের প্রায় ২০ টন মাছ ও সাড়ে ৪ টন পোনা ভেসে যায়। দুইটি মুরগী খামারের প্রায় ৯০০ মুরগি মারা যায়। এছাড়া প্রস্তুত থাকা ছয়টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১০ জন মানুষ আশ্রয় নেয়। এদিকে দুর্গতদের সহায়তায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা, ১৬৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন গ্রাম থেকে পানি নামতে শুরু করায় ক্ষত চিহ্নগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। ভাঙ্গন স্থান দিয়ে অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো তৈরি করে স্থানীয়রা কোন রকমে পার হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ও ফসলি জমির ক্ষতও দৃশ্যমান হচ্ছে। মৎস্য চাষীরা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরগুলোর পাড় নির্মাণের কাজ শুরু করেছে।

গত ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মুহুরীকহুয়াসিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬৭ স্থানে ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। এতে গত ৬ বছরে বাঁধ সংস্কারে ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, জলের টাকা জলেই গেছে। এতে বাঁধ ভাঙন রোধ হয়নি, স্থানীয়দের দুর্দশাও মেটেনি। বরং বর্ষা মৌসুমে বাঁধের যেকোন স্থান যেকোন সময় ভাঙতে পারে, এ নিয়ে আমাদের শঙ্কা আজও দূর হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনী হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ২০১৮ সালের বাঁধের ৭ স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছর বাঁধ সংস্কারে প্রায় ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। এর পরের বছর ২০১৯ সালের বন্যায় ২২ জায়গায় বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সেসময় বাঁধ সংস্কারের প্রায় ১ কোটি ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে বাধেঁর ১৫টি স্থানে ভেঙ্গে যায়। এতে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধের ৭শ মিটার মেরামত করা হয়। ২০২১ সালের বাঁধের ৯টি স্থানে ভাঙন মেরামতের জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ২০২২ সালের ৬ স্থানে ভাঙা বাঁধ মেরামতের জন্য ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। চলতি মৌসুমে বাঁধের ৩টি স্থান এখন পর্যন্ত ভেঙ্গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঘুরেফিরে বাঁধ সংস্কারের কাজ পেয়েছে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে রয়েছে মেসার্স ফেনী ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন, মেসার্স কাশেম ট্রেডার্স, মেসার্স ইমেজ ইন্টারপ্রাইজ, মেসার্স শাহ সুফি এন্টারপ্রাইজ নামীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, বন্যা থেকে রক্ষা পেতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও তা বাসিন্দাদের কোনো কাজে আসছে না। ভাঙন কবলিত স্থানসহ নতুন নতুন জায়গা প্রতি বছরই বাঁধ ভাঙে। প্রতিবছর এসব ভাঙন মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বছর ঘুরে সে টাকা পানিতে ভেসে যায়। স্থায়ী সমাধান না করে প্রতিবছর নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় মানুষের।

ফুলগাজী উপজেলার বাসিন্দা সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, একই জায়গা বার বার ভাঙে। একই জায়গার জন্য বরাদ্দও দেয়া হয়। আবার একই ঠিকাদার কাজ পায়। বন্যা হলে কিছু অসাধু কর্মকর্তার কপাল খুলে যায়। পাউবো কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় খামখেয়ালীভাবে ঠিকাদাররা যেনতেন ভাবে মেরামতের কাজ করছেন। যার কারণে একই জায়গা বারবার ভাঙছে। আর মানুষরা বার বার ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে আশীর্বাদ নয়, প্রতি বছরই একাধিকার এই বাঁধের একাধিক স্থানে ভেঙে অভিশাপই বয়ে আনছে স্থানীয়দের জন্যে। এর একটি স্থায়ী সমাধান করা হোক। ভাঙার কারণ হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতাকে দায়ী করেন তারা।

মুহুরী নদীতে স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করা পর্যন্ত এ জনপদ ক্ষতি কমার সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা একরাম উদ্দিন।

তিনি জানান, প্রতি বছরের বন্যার পানিতে এলাকার কয়েকশ কৃষক ক্ষতির শিকার হন। তবে এ হিসাব পরিপূর্ণ নয়। ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তাই সঠিক ক্ষতির হিসাব রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য। মুহুরী নদীর বাঁধ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই।

স্থানীয়রা জানান, মুহুরী নদী শাসন, অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন বন্ধসহ সিলোনীয়া, কহুয়া ও গথিয়া নদী ও খালের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুনঃখনন করা সময়ের দাবি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য খোকন জানান, শুধু ফসলের ক্ষতিই নয়, ঋণের ভারেও জর্জরিত হচ্ছেন কৃষকরা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. রাফিউস সাজ্জাদ বলেন, নদীর নাব্যতা ও সরু হয়ে যাওয়ায় নদীতে পানির ধারন ক্ষমতা কমে গেছে। ১২২ কিলোমিটার নদী খননসহ দুই পাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে নেয়া হয়েছে ৭৩১ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প।

উল্লেখ্য, বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মুহুরী ও কহুয়া নদী রক্ষা বাঁধ ভাঙ্গনে নিঃস্ব হচ্ছে নদী পাড়ের বাসিন্দারা। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি টেকসই বাঁধ নির্মাণের।

 

 

মোরশেদ আলম/দীপ্ত নিউজ

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More