মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪
মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: একক কোনো দলের নয়, জাতীয় অর্জন

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

মেহেদী সুমন

দেশের মানুষের বহু বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের যে ফেনিল স্রোত, তা এক হয়ে এক দফা আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। গত জুলাই মাসে শুরু হওয়া কোটা সংস্কারের দাবিতে অরাজনৈতিক ও অহিংস ছাত্র আন্দোলনকে দমাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্মম গণহত্যা সংঘটিত করে। তবে সারা বাংলার অকুতোভয় ছাত্রজনতা এবং দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে এই আন্দোলন রাজনৈতিক রূপান্তর লাভ করে। ফলে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, খুনগুম, ভোটাধিকার হরণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকৃত ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক দলীয়করণ, চাঁদাবাজি ও ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে। এর ফলে গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস।

. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনকে কার্যকর করতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছেন, ফলে দেশের মানুষ জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ফ্যাসিবাদের পতিত শক্তি সকল স্তরে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সরকারের বিভিন্ন স্তরে স্বৈরাচারের চিহ্নিত দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে আছে, যা শহিদের রক্তের সাথে চূড়ান্ত বেইমানির শামিল।

দেশে আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনাও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রকাশ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে, পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির দাবার গুটিতে পরিণত হতে পারে।

গণতন্ত্রকামীফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠন না করা হলে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বেহাত হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির প্লেগ্রাউন্ডে পরিণত হতে পারে, যা মোটেও কাম্য নয়।

কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কার্যকলাপ এবং বালখেল্য বক্তব্যবিবৃতির জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে না। অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের জনগণ আর মেনে নেবে না।

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং সংঘাতহীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বারবার হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত অগণিত প্রাণ ফ্যাসিবাদীস্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে বিসর্জিত হয়েছে। জুলাই ২০২৪এ সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে শত শত তরুণ ছাত্রজনতা জীবন দিয়েছে একটি টেকসই কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিনির্মাণের স্বপ্নে, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ও মৌলিক নাগরিক অধিকার সমুন্নত থাকবে।

এই ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কুঠারাঘাত করেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শহীদ আবু সাঈদ। তিনি বুক চিতিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ সুগম করেন। সেই দিন আবু সাঈদের স্নেহময়ী বোন সুমির গগনবিদারী আর্তনাদে বাংলাদেশের আকাশবাতাস প্রকম্পিত হয়।

১৬ জুলাই হাসিনাবিরোধী ভয়াল যুদ্ধে আরও ৫ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম অন্যতম। আবু সাঈদওয়াসিমের আত্মদান দেশের হাজার হাজার ছাত্রজনতাকে অনুপ্রাণিত করে। আপামর জনসাধারণ বুলেটের সামনে দাঁড়ায় পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে।

শেখ হাসিনার নির্দেশে বিভিন্ন বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে বহু শিশুকিশোর এবং ছাত্রজনতা নিহত হয়। ফলে দেশের মানুষের মনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আগুন জ্বলে ওঠে। মানুষের এই ক্ষোভ এক সময় গণজোয়ারে রূপ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের পর এমন গণআন্দোলন দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

গত মধ্য জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের রাজাকারের নাতিপুতিবলে কটাক্ষ করেন, যা আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে। সরকারি বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে শেখ হাসিনা আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রজনতা দলমত নির্বিশেষে রাজপথে নেমে আসে।

ধারাবাহিকভাবে এ আন্দোলন এগিয়ে যায়, যেখানে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব শ্রেণিপেশার মানুষ সমানভাবে অংশ নেয়। বহু বছরের অপশাসনে নিপীড়িত নাগরিক সমাজের চাওয়া এবং রাষ্ট্র সংস্কারের আকাশসম আকাঙ্ক্ষা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে এসে এক দফা দাবিতে রূপান্তরিত হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যে আকাশসম স্পিরিট তা একটি মহল কতিপয় ব্যক্তির অর্জন হিসেবে দেখানোর পায়তারা চালাচ্ছে। যেমন আওয়ামী লীগ একাত্তরের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধকে একদলীয় অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এমন অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকা উচিত। এই আন্দোলনের বিজয় জাতির—এটি কোনো একক দলের নয়।

বিএনপি ২৬ জুলাই এক দফা দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়,যার সাথে আরও অনেক নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে।

দেশের ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে, লুণ্ঠিত ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, অধিকারহীন জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে এক দফা দাবিতে দেশের সব গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দল,সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠন,ব্যক্তি ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের আহ্বান করলে গণতন্ত্র মঞ্চের চার দল, ১২ দলীয় জোটের ১২ দল, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ১১ দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের চারটি দল,গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি,গণফোরাম, পিপলস পার্টি এবং লেবার পার্টি জাতীয় ঐক্যে সংহতি জানায়। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ বিএনপি ঘোষিত এক দফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে রাজপথে জোড়ালো ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ও ববি হাজ্জাজের এনডিএমসহ কিছু ইসলামী,বাম ও ডানপন্থি রাজনৈতিক দল সংহতি জানায়।এতে দেশের লাখ লাখ মানুষ আন্দোলনে সামিল হতে শুরু করে। বিএনপি দলগতভাবে ছাত্রজনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে স্বৈরাচারের দানবীয় শক্তিকে প্রতিরোধ করে।

ছাত্র জনতার নির্বিচার মৃত্যুর ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ নামে অভিহিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ।গণগ্রেপ্তার ও নির্বিচার গুলি বন্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের শিক্ষকেরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি করেন।

সরকারের নৃশংসতা যত বাড়ছিল, আন্দোলনের গতি তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। দাবিদাওয়া এবং মিছিলস্লোগানে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। পরিবর্তনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা একসময় শেখ হাসিনার পতনের এক দফা ভিত্তিক স্লোগানে রূপান্তরিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল কর্মীদের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো রাজপথে শেখ হাসিনার পতনের স্লোগান ওঠে।

এই গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড তারাই, যারা ফ্যাসিবাদের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির নেশায় মত্ত হয়ে অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ঐতিহাসিক এই গণবিপ্লবে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনসমূহের ৪২২ জন নেতাকর্মী শহীদ হন। তাদের আত্মত্যাগে জনসাধারণ মৃত্যুকে তুচ্ছ করে রাজপথে নেমে আসে, এবং এটি একসময় গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

এ আন্দোলন কারও একক চাওয়ায় বা নেতৃত্বে হয়নি। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমূল সংস্কারের স্বপ্নে ছাত্রজনতা যুগপৎ লড়াই করেছে। ১৯ জুলাই রংপুরে শহীদ সাজ্জাদ (সবজি বিক্রেতা) কিংবা ঢাকায় গুলিবিদ্ধ রিকশাচালক, তারা কেউই শুধু চাকরির জন্য জীবন দেননি, তারা একটি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নে প্রাণ দিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনার শাসনের দানবীয় অবসান ঘটে,

যা দেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কাজেই একটি জাতীয় অর্জনকে কতিপয়ের অর্জন হিসেবে মহিমান্বিত করার সংকীর্ণতা থেকে সরে আসতে হবে।জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে সবার ভূমিকাকে স্বীকার ও সম্মান করতে হবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আল/ দীপ্ত সংবাদ

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More