রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে আইডিয়াল কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটি আমাদের সমাজের গভীর সংকটের বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের সংঘর্ষকে শুধু দুইটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘটা ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে; বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
দেশের তরুণ সমাজ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা, মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটি অসংবেদনশীল এবং উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে অবস্থান করে। তারা নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি প্রদর্শন করতে চায়। প্রাচীন কালের যুদ্ধের মতোই, যেখানে বিজয়ী পক্ষ পরাজিতের প্রতীকগুলোকে তুলে নিয়ে যায়। এই প্রাচীন প্রবৃত্তি আজও আমাদের সমাজে বিরাজমান। শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষ এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হওয়া কেবল তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা অসহায়ত্ব এবং শক্তির প্রদর্শনীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। এর পেছনে রয়েছে তাদের অপ্রাপ্তি, হতাশা, এবং নিজেদের মধ্যে নিজেদের সেরা প্রমাণ করার তাগিদ। কিন্তু এই শক্তি যে একত্রিত হয়ে একটি গঠনমূলক বা সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করা উচিত, সেটি তারা ভুলে যায়। বরং তারা নিজেদের মধ্যে বিভাজিত হয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র পরিচয়ের ভিত্তিতে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যা কেবলমাত্র তাদের শক্তিকে নষ্ট করে এবং সমাজের স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করে।
সমাজতাত্ত্বিকভাবে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে একটি দ্বৈত সংকটে ভুগছে। একদিকে তাদের শক্তি এবং উদ্যমকে সঠিক পথে পরিচালিত করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে সমাজের ভেতরে গভীরভাবে প্রবেশ করা সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধতা তাদের একত্রিত হতে দিচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে বিভাজিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এই বিভাজন কেবল সমাজের একটি ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন। জাতি হিসেবে আমরা কেন একত্রিত হতে পারছি না, তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ শিক্ষার্থীদের এই সংঘর্ষ।
শিক্ষার্থীরা কেন আজ নিজেদের পরিচয়ের সংকটে ভুগছে? আমাদের সমাজের শিকড় কোথায়? আমাদের কীভাবে এবং কেন এত বিভাজিত করা হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের নৃতত্ত্বে ফিরে যেতে হবে। বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক গোষ্ঠীভিত্তিক পরিচয়গুলো কীভাবে এবং কেন গুরুত্ব পেয়েছে, সেটি বুঝতে হলে আমাদের ইতিহাসের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। জাতিগত এবং আঞ্চলিক বিভাজনগুলো যে আমাদের সমাজে কতটা গভীরে প্রোথিত, সেটি এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
এই ঘটনা শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতারও প্রতিফলন। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং রাজনীতি এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করে। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের বিভাজিত রাখার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা সংহত করতে চায়। এটি একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এই ধরনের সংঘর্ষের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও একটি দিক। আমাদের সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য এতটাই প্রকট যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ এবং হতাশা বেড়ে চলেছে। এ ধরনের সংঘর্ষের মাধ্যমে তারা নিজেদের ক্ষমতার প্রদর্শনী করতে চায়, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে তাদের অসহায়ত্ব এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি বঞ্চনা। এই সংঘর্ষ কেবলমাত্র একটি অস্থায়ী প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত হতাশা এবং বঞ্চনার ফলাফল।
এই সংঘর্ষ আমাদের সমাজের সামগ্রিক সংকটের একটি প্রতীক। আমাদের শিক্ষার্থীরা আজ যে সংকটের মুখোমুখি, তা শুধু তাদের নিজেদের সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের গভীরতর সমস্যা। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সমাজকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং তরুণদের শক্তিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের বিভক্তির মধ্যে নয়, বরং ঐক্যের মধ্যে শক্তি খুঁজে পেতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যেখানে আমরা সবাই মিলে এই সংকটের মূল কারণগুলো খুঁজে বের করব এবং একটি সমাধানের পথে এগিয়ে যাব।
লেখক: মাসউদ বিন আব্দুর রাজ্জাক, নিউজ এডিটর, দীপ্ত টিভি।