স্মরণকালের বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখছে ফেনীর পাঁচ উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদের তিন লক্ষ মানুষ। সম্পদ নয়, প্রাণ বাঁচানোই মুখ্য হয়ে উঠেছে মানুষের। ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপ ও অবিরাম বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ারসার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দিয়েছেন।
তবে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ও পানির প্রবল স্রোত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম। বন্ধ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগও নেই।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সময়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন দুর্গত অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। সেনা ও কোস্টগার্ডের ২৪টি বোট উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বন্যায় জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ।
পরশুরামের বীর চন্দ্রনগর গ্রামের আবদুল কাইয়ুম জানান, প্রবল স্রোতে এখন সম্পদ নয়, মানুষের জান বাঁচানোই দায় হয়েছে। বন্যার্তরা প্রাণ বাঁচানোর করুন আকুতি জানাচ্ছে। ভোট বা নৌকা নিয়ে তাদের উদ্ধারের জন্য।
পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাঁচার আশায় আশ্রয়ের সন্ধানে ফেনী শহরের একটি হোটেলে এসে উঠেছেন আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল হিসেবে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।
ছাগলনাইয়া সাংবাদিক নুরুজ্জামান সুমন জানান, পরিবার–পরিজন নিয়ে পানিবন্দী হয়ে আছেন। উদ্ধারের জন্য তিনি বোট বা নৌকা সহায়তা কামনা করেছেন।
ফেনী শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শফিউল আলম। বুধবার দুপুরে মোবাইল ফোনে পরশুরামের মধ্যম ধনীকুন্ডা এলাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় তার। তিনি বলেন, সন্তানদের নিয়ে প্রাণে বাঁচতে পাশের একটি দোতলা ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারের সদস্যরা। সেখানে তখন পানিতে নিচতলা পুরোটা ডুবে ছিল। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। পানির তীব্রতার কারণে বাড়ি ফেরারও পরিস্থিতি নেই। এছাড়া শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ভয়ানক দুঃসময় কাটছে আমাদের।
পরশুরামের শালধর গ্রামের মো. রহিম জানান, বেশিরভাগ এলাকার একচালা ও একতলা পাকাঘর ডুবে গেছে। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
আনন্দপুর ইউনিয়ন মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা হলেও ১৯৮৮ সালের পর এই ধরনের ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। তিন উপজেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
দাগনভূঞা উপজেলার ওমরাবাদ গ্রামের আকবর হোসেন বলেন, পরিবার–পরিজন নিয়ে কেবল প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো অন্যের হেফাজতে রেখে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। পানিতে ঘরবাড়িসহ চারপাশ ডুবে গেছে।
ফেনী শহরের ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন লিটন বলেন, শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত। দোকানপাটে পানি প্রবেশ করে মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে হু–হু করে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঠিকভাবে উদ্ধার কাজও করা যাচ্ছে না। এখনো বৃষ্টির সঙ্গে পানি বাড়ছে।
জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। এখনো পাঁচ উপজেলার তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কতজনকে উদ্ধার করা হয়েছে বা কোন এলাকায় কেমন আক্রান্ত হচ্ছে তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। পানির তীব্র স্রোতের কারণে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না।
মামুন/ আল/ দীপ্ত সংবাদ