গত একযুগ ধরে ফাঁস হয়ে আসছে সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন। বিষয়টিকে মহামারি হিসেবে দেখছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা।
তারা বলছেন, সারাজীবন কষ্ট করে পড়াশোনা করেও সরকারি চাকরি পাচ্ছি না। অন্যদিকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন কিনে বড় বড় সরকারি কর্মকর্তার হয়ে যাচ্ছেন অসাধুরা। সরকারি বড় বড় কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এসব হচ্ছে।
সম্প্রতি বেসরকারি একটি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় প্রায় এক যুগ ধরে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে আসছে। এমনকি সবশেষ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। সবশেষ গত শুক্রবার (৫ জুলাই) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ৫১৬টি পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়। ৩৩তম বিসিএস থেকে ৪৬তম বিসিএস পর্যন্ত প্রায় ৩০টি ক্যাডার–ননক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। আর এসব প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত পিএসসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
প্রশ্নফাঁসের বিষয়টিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা এবং মহামারি হিসেবে দেখছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ— সরকার এ বিষয়ে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছে। এতে অনেক মেধাবী চাকরিপ্রার্থী বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে প্রশাসনসহ কোনো সেক্টরেই যোগ্যপ্রার্থীরা ঢুকতে পারছেন না।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকর্মী ফারজানা আক্তার নিজের স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বিসিএসএর প্রশ্নফাঁস! কি ভয়ানক বিষয়। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে– আমি এত মেধাবী হয়েও কেন বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছি না। ধরেন, আপনি দিন–রাত এক করে প্রিপারেশন নেয়ার পর প্রশ্ন ফাঁসের কারণে আপনার মেধা থাকা সত্ত্বেও উত্তীর্ণ হলেন না, তখন কেমন লাগবে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবির ফাহিম তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে জন্মই যেখানে আজন্ম পাপ। পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়া উচিত। এখানে মেধার দাম নেই।‘
বেসরকারি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকিব আল জামান লিখেছেন, ‘একজন শিক্ষার্থীর ২০–২৩ লেগে যায় পড়াশোনা শেষ করতে করতে। অনেক চাকরি অফার ফিরিয়ে দেয়। শুধুমাত্র সরকারি চাকরির প্রত্যাশায়। বাবাকে হাত খরচ দেয়ার বয়সে বাবার থেকে হাত খরচ নিয়ে বিসিএস বা সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেয়; এই আশায় যে এক সময় চাকরি হবে আর সবার সব ধার–দেনা শোধ করবে। বছরের পর বছর অপেক্ষা এই অপেক্ষার মূল্য কিভাবে হবে শোধ!’
এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক জামির হোসেন বলেছেন, ‘বিসিএস প্রস্তুতি কোচিংয়ে যাদেরকে বলেছিলাম পিএসসির প্রশ্নফাঁস হয় না। তারা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার ভুল হয়েছে।‘
এদিকে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রসঙ্গ টেনে সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের টাকা দিয়ে একশজনকে এক কেজি করে গরু মাংস দেয়াকে মানবিক কর্মসূচি বলা হয়।‘
এদিকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) নেয়া বিসিএসের ক্যাডার এবং নন–ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বই পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ১০–১৫ জন শিক্ষার্থী। রবিবার (৭ জুলাই) রাতে বই পোড়ান তারা।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁস চক্রে পিএসসির অন্তত ১২ জন কর্মকর্তা–কর্মচারী জড়িত। এর মধ্যে বিভিন্ন ইউনিটের উপ–পরিচালক, সহকারী পরিচালক, চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক, সাবেক সচিবের পিএসও রয়েছেন।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁস চক্রের মূলহোতা পিএসসি’র অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ‘পিএসসি’র উপ–পরিচালক আবু জাফরের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বিনিময়ে রেলওয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়। পিএসসির একজন সদস্যের অফিসে সংরক্ষিত ট্রাঙ্ক থেকে আবু জাফর রেলওয়ের প্রশ্ন আমাকে বের করে দিয়েছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, আমি এটাও জানি ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।
বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কমিশনের ক্ষমতাবলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠতে পারে। সেটি প্রমাণ হতে হবে। প্রমাণ হলে, কমিশন যদি মনে করে তাহলে প্রশ্নফাঁস হওয়া বিসিএসের কার্যক্রম বাতিলও হতে পারে।’
আদীব জামাল/দীপ্ত সংবাদ