শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪
শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪

এক সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষা: মা পাশ, মেয়ে ফেল

ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন নীলফামারী।

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

নীলফামারীর ডিমলায় মেয়ের সাথে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন মারুফ আক্তার। তবে ফেল করেছেন মেয়ে শাহী সিদ্দিকা।

তিনি চলতি বছর শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব সরকারী মহাবিদ্যালয় থেকে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পেয়েছেন জিপিএ ৪.৩৮। আর মেয়ে শাহী একই কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অকৃতকার্য হয়েছেন।

বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টায় প্রকাশিত ফলাফলে এই তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, মারুফা আকতার ডিমলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখা থেকে মেয়ের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৩৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন ও তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা একই কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পর্দাথবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে অকৃতর্কায হয়েছেন।

এর দুই বছর আগে এসএসসি পরীক্ষায় একসঙ্গে অংশ নিয়ে মেয়ের চেয়ে ভালো ফলাফল করেন মারুফা আকতার। তিনি এসএসসিতে জিপিএ-৪.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন এবং তার মেয়ে শাহী সিদ্দিকা পেয়েছিলেন জিপিএ-৩।

২০০৪ সালে এসএসসি দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু পরীক্ষার আগেই অভিভাবকেরা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। সংসারের দারিদ্র্যতার কারণে একইভাবে মেয়ে শাহী সিদ্দিকাকেও দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন মারুফা। অদম্য এ নারী নীলফামারী ডিমলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের পুন্যারঝার গ্রামে সাইদুল ইসলামের স্ত্রী। মারুফার স্বামী পেশায় একজন মাছ ব্যবসায়ী। দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে মেয়ে শাহী সিদ্দিকা বড়। দ্বিতীয় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী, তৃতীয় মেয়ে নবম শ্রেণি ও ছোট মেয়ে ৬ষ্ট শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে দশম শ্রেণিতেই লেখাপড়া শেখার অদম্য ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে রেখে মারুফা আকতারকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বিয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। পিঠাপিঠি চার ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতেই চলে যায় ১৫টি বছর। সচরাচর কোনো কিশোরীর লেখাপড়ার ইচ্ছেশক্তি আর এতো বছর বাঁচে না। কিন্তু মারুফা আক্তার দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে জয় করা যায়।

দীর্ঘ ১৫ বছরে অভাবী সংসারে চারজন নতুন অতিথি এলেও মারুফার লেখাপড়ার ইচ্ছা দমেনি। এত কিছুর পরেও মারুফা চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, কীভাবে নিজেকে এবং মেয়েকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনা যায়। এরই চেষ্টায় স্থানীয়ভাবে নিজেকে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। কিছুটা হলেও সংসারে আয় ফিরতে শুরু করে। নিজের অদম্য ইচ্ছা শক্তির জোরে সুপ্ত বাসনাকে পূরণ করতে স্বামীর উৎসাহে মেয়ের সঙ্গে পুনরায় ছোটখাতা ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হন নবম শ্রেণিতে।

এরপর ২০২০ সালে মেয়ের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন মারুফা। এমনকি মেয়ের চেয়ে ভালো ফলাফল করেন তিনি। সারাদিনের প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর গভীর রাত ও ভোরে উঠে নামাজ শেষে লেখাপড়া শুরু করেন। মারুফা আক্তার তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ডিমলা বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট কেন্দ্র থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। তার ইচ্ছা সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তিনিও নিজেকে একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে চান। মারুফার আশা পূরণ হয়েছে, তবে মেয়ের ফল খারাপের কারণে কিছুটা হলেও মন খারাপ।

এদিকে মারুফার এ ফলাফলে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই খুশি। মারুফা আক্তার বলেন, ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। অভাবের সংসারে বড় হয়েছি। ২০০৩ সালে যখন এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। ইচ্ছা থাকলেও প্রতিবাদ করে পড়াশোনাটা করতে পারিনি। তবে পড়াশুনার তাড়নায় মনে দাগ কেটেছে সব সময়।

তিনি বলেন, বিয়ের পর চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের পড়ার কথা ভাবার সময়ই হয়নি। পরে নিজের অদম্য ইচ্ছা ও স্বামী ও সন্তানদের অনুপ্রেরণায় আবার পড়াশোনা শুরু করি। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো আমিও একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে যাতে নিজের পরিচয় দিতে পারি। এজন্যই কষ্ট করে পড়াশোনাটা আবার শুরু করেছি। এইচএসসি পাশ করে কষ্ট স্বার্থক হয়েছে।

মারুফা বলেন, মেয়ের ফলাফল কিছুটা খারাপ হওয়ায় সবার মন খারাপ হলেও আমার ফলাফলে সবাই খুশি। এবার ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাই। ভর্তিযুদ্ধে সফল হতে সর্বচ্চ প্রস্তুতি নিবো। মারুফা আক্তারের স্বামী সাইদুল ইসলাম বলেন, আমি তার ইচ্ছেটার মর্যাদা দিয়েছি। সে যতদূর পড়াশোনা করতে পারে, আমি চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করবো। তার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। মা ও মেয়ে এক সঙ্গে পাশ করলে আরও ভালো লাগতো।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) বেলায়েত হোসেন বলেন, চরম দারিদ্র্যতার মাঝেও প্রত্যন্ত গ্রামের মারুফা এইচএসসিতে শুধু পাসই করেনি, ভালো ফলাফল অর্জন করেছেন। তার বিষয়টি আসলে অবাক লাগানোর মতো। বিষয়টি অনেকের অনুপ্রেরণা জাগাবে। উচ্চতর শিক্ষায় লেখাপড়ার সুযোগ পেলে আমরাও তার পরিবারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব। আমিচাই তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করুক। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, মা মারুফা একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকলে লেখাপড়ায় বয়স কোনো বাধা নয় তিনি সেটা প্রমাণ করেছেন। মারুফা আক্তারের এমন উদ্যোগ অনেককে অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তার সাফল্য কামনা করি।

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More