ক্রিকেট ম্যাচে লড়াইয়ের ভেতরও থাকে অনেক ছোট ছোট লড়াই। সেই লড়াইগুলির ফলাফলই দিনশেষে গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য। সেখানেই সাকিব কালকের ম্যাচের নায়ক। ম্যাচ সেরার পুরস্কারও হয়তো পুরোপুরি বলতে পারছে না, এই ম্যাচে কত লড়াইয়ে জিতলেন সাকিব!
সবচেয়ে বড় লড়াইটা তিনি নিজেই ডেকে এনেছিলেন। ম্যাথিউসকে ‘টাইমড আউট’ করে আলিঙ্গন করেছিলেন বড় চ্যালেঞ্জ। সেধে মাখামাখি হয়েছিলেন চাপের সঙ্গে। এরপর তার আর পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ ছিল না। তিনি তাকাননি। চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারের মতোই সমস্ত চ্যালেঞ্জকে দিয়েছেন পাল্টা জবাব।
তবে খেলায় বারবার লঙ্কানদের সাথে কথার প্যাঁচে আটকে যায় টাইগার খেলোয়াড়রা। লঙ্কানদের স্লেজিং থামাতে পারছিলেন না মাঠে থাকা ২ আম্পায়ারও। হৃদয়, শান্তরাও ছাড় দেয়ার নয়। তারাও জবাবটা দিলেন বেশ ভালোভাবেই। কখনো তেড়ে এসে আবার কখনো ব্যাট হাতে বাউন্ডারি মেরে সঠিক জবাব দিলেন তারা। এক সময় মনে হল এ যেনো ফুটবলের এলক্লাসিকো।
তবে আলোচনা সমালোচনা চাপিয়ে আইসিসি থেকে এ ম্যাচের পুরস্কার ঠিকই পেয়েছেন সাকিব। ব্যাট হাতে ৬৫ বলে ৮২ রান আর বল হাতে ১০ ওভারে ৫৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট। তাতেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে আরেক রেকর্ড করলেন সাকিব। ওয়ানডে ক্রিকেটে ২৭ বার ম্যাচ সেরা হয়ে স্পর্শ করলেন ইউভরাজ ও এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো অলটাইম গ্রেটদের দুজনকে।
অন্যদিকে মাঠ এবং মাঠের বাহিরে বিতর্কিত আচরণে আইসিসি থেকে জরিমানা গুণতে হতে পারে ম্যাথিউসকে। তবে এখনো শাস্তির মুখে পড়েনি তিনি। মাঠের ভেতরে লঙ্কানদের বিতর্কিত আচরনে শাস্তি হতে পারে বলে মনে করছেন ক্রিকেট বোদ্ধারা।
ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ম্যাথিউস বলেন, ‘আসলে আজকের আগ পর্যন্ত আমার সাকিবের প্রতি এবং বাংলাদেশ দলের প্রতি অনেক সম্মান ছিল। আমরা সবাই জেতার জন্যই খেলি। যদি এমন হত যে এটি নিয়মের মধ্যে তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। নিয়মে বলা আছে আমাকে ২ মিনিটের মধ্যে ক্রিজে যেতে হবে। আমাদের কাছে ভিডিওসহ প্রমাণ আছে। আমি কেবল এসেই এখানে কথা বলছি না। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে। আমার হেলমেট ভাঙার পরেও আরও ৫ সেকেন্ড সময় বাকি ছিল। এখন কি আমি হেলমেট ছাড়াই গার্ড নেব? আমরা তো ক্রিকেটারদের সুরক্ষার ব্যাপারে কথা বলি তাই না? এখানে পুরোটাই কমনসেন্সের ব্যাপার। আম্পায়াররাও এখানে আরও দায়িত্বশীল হয়ে ঘটনাটা চেক করে দেখতে পারতেন।’
তার এমন অশোভন আচরণ আইসিসির নিয়ম ভঙ্গের মধ্যে পড়ে বলে শাস্তি হতে পারে ম্যাথিউসের।
ম্যাচে লঙ্কানরা চায় সাকিবদের পিছনে লেগে থাকতে গ্রামের সতী নারীদের মত। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের হাতে কোনো ঘড়ি ছিল না। তবু সাকিব আল হাসানকে আউট করার পর তিনি ঘড়িতে সময় দেখানোর মতো ভঙ্গি করলেন। বুঝতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নিজের ‘টাইমড আউট’ নিয়েই খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার। তার হয়তো ভাবনায় ছিল না, সময়ের খেলায় অনেক দেরি হয়ে গেছে তাদের! সাকিব তো ম্যাথিউসকে পাত্তাই দিল না। যেনো তিনি কিছুই দেখেননি। তবে ওই এক ডেলিভারিতে ম্যাথিউস জিতলেও আরও অনেক লড়াইয়ে ততক্ষণে জিতেই গেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক!
সামারাউইক্রামাকে আউট করার পরপরই ম্যাথিউসকে ‘টাইমড আউট’ করার আবেদন করলেন, আম্পায়ারের দুই বার জিজ্ঞাসা এবং ম্যাথিউসের অনুরোধেও অবস্থান থেকে সরলেন না। ম্যাচের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আগুন নিয়ে খেলা!
সবচেয়ে বড় কথা, তিনি জানতেন যে ক্রিজে যাওয়া মাত্রই প্রকিপক্ষ চেপে ধরবে নানা ভাবে। ‘টাইমড আউট’–এর ‘বদলা’ নেওয়ার চেষ্টা করবে প্রবলভাবে। কিন্তু সাকিবের ভাবনায় তো এটি যুদ্ধক্ষেত্র। সেনাপতিকে তো সামনে থেকেই লড়তে হয় প্রবলবিক্রমে! সাকিব দাঁড়িয়ে গেলেন ব্যাটকে তরবারি বানিয়ে।
তিনি উইকেটে যাওয়া মাত্রই কাছে গিয়ে কিছু একটা বললেন ম্যাথিউস। উষ্ণতায় ভরা সাদর সম্ভাষণ নিশ্চয়ই নয়! ক্রিজের চারপাশ থেকে লঙ্কানরা কথার তোপ দাগাতে থাকলেন। লড়াইটা তখন অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। মনোযোগ নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা, কথার তিরে বিদ্ধ করে ড্রেসিং রুমে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা।
পাওয়ার প্লে শেষ হতেই বল হাতে এগিয়ে এলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস। মনোজগতের আরেকটি লড়াই! সাকিব এবার ফাঁদে পা দিলেন শুরুতেই। প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারার চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। পরের বলে আবার একই চেষ্টায় ক্যাচ দিয়ে বসলেন। তবে দিনটি তো তার! আসালাঙ্কা তাই মুঠোয় জমাতে পারলেন না বল।
তবে সাকিবের জয়গাঁথা ততক্ষণে প্রায় রচিত হয়েই গেছে। দলের জয়ে পরে তা পূর্ণতা পেল। সেঞ্চুরি না পেলেও ৬৫ বলে ৮২ রানের যে ইনিংসটি খেললেন, তা মনে করিয়ে দিল সেরা সময়ের সাকিবকে। ওয়ানডেতে ফিফটি ছোঁয়া ইনিংসে গত সাত বছরের মধ্যে তার সেরা স্ট্রাইক রেটের ইনিংস এটি (১২৬.১৫)।
ম্যাচ সেরার পুরস্কার তোলা ছিল তার জন্যই। এই নিয়ে চারবার ম্যান অব দা ম্যাচ হলেন বিশ্বকাপে, যেখানে তার সঙ্গী ভিরাট কোহলি, সৌরভ গাঙ্গুলি, ব্রায়ান লারা, শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়াহ, আরাভিন্দা ডি সিলভা, ডেভিড বুন, কুমার সাঙ্গাকারা, ইউভরাজ সিং, মাহেলা জায়াওয়ার্দেনের মতো তারকারা।
মোরশেদ আলম/দীপ্ত নিউজ