হজ ধনী লোকদের জন্য অবশ্যই পালনীয়। সকল মুমিন বান্দা হজ পালন করতে চায়। ‘হজ‘ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো– ইচ্ছা ও সংকল্প। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ বা কাবা ঘর জিয়ারত করার ইচ্ছা ও সংকল্পকে হজ বলা হয়। মুসলিমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে বলে এর নামকরণ করা হয়েছে হজ।
কাবা ও হজ এর প্রসঙ্গ আলোচনা করলে চোখের সামনে ভেসে উঠে ইব্রাহিম (আ.) এর নাম।
কারণ তাঁর মাধ্যমে কাবা ও হজ প্রতিষ্ঠা ও প্রবর্তন হয়েছে। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছরের বেশি পূর্বে তিনি ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন। তার জাতি ছিল সে সময়ের সবচেয়ে উন্নত জাতি। জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প ভাস্কর্যে তারা চরম উন্নতি লাভ করে।
কিন্তু নৈতিক ও আদর্শিকভাবে তারা ছিল চরম অধঃপতিত। এক আল্লাহকে পরিত্যাগ করে তারা সম্পূর্ণভাবে শিরকে লিপ্ত হয়ে পরেছিল। তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকা, এবং মাটি ও পাথরের নির্মিত মূর্তির পূজা করত। এমনকি ইব্রাহিম (আ.) যে বংশে জন্মগ্রহণ করেন সেটাই ছিল পেশাদার ও বংশক্রমিক পূজারি। পৌওালিকায় আকন্ঠ নিমজ্জিত এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেও ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
ইব্রাহিম (আ.)-এর একমাত্র চিন্তা ছিল দুনিয়ার মানুষকে শিরকের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর বান্দায় পরিণত করা। কিন্তু শিরকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেই সমাজ এই একনিষ্ঠ তাওহীদবাদী মহাপুরুষকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এজন্য তিনি বছরের পর বছর উদাভ্রান্ত পথিকের ন্যায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কখনো কেনানের জনপদে, কখনো মিশরের আবার কখনো আরবের মরুভূমিতে। এভাবেই তার গোটা যৌবনকাল অতিবাহিত করলেন।
জীবনের শেষভাগে এসে তিনি আল্লাহ তায়ালা কাছে ৮৬ বছর বয়সে পুএ সন্তান কামনা করলেন।
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নেকসন্তান উপহার দিলেন। সন্তানটি একটু বড় হলেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে কুরবানী দেওয়া জন্য আদেশ দিলেন আল্লাহ খলিল ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ পালনে সামান্যতমও কুণ্ঠিত হলেন না। তিনি নিজ হাতে প্রিয় সন্তানকে কুরবানী করতে উদ্ধত হলেন। আল্লাহ তায়ালা বেহেশতি একটি দুম্বাকে ইসমাঈলের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং সেটিই কুরবানী হয়ে যায়। তখন থেকে কুরবানী বিধান প্রবর্তন করা হয়।
এভাবে ইব্রাহিম (আ.) যখন সকল পরীক্ষায় সফলতা সাথে উওীর্ণ হলেন তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতা হিসাবে মনোনীত করলেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:- ২–আল–বাক্বারাহ: আয়াত: ১২৪
۞ وَإِذِ ٱبْتَلَىٰٓ إِبْرَٲهِــۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَـٰتٍ فَأَتَمَّهُنَّۖ قَالَ إِنِّى جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًاۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِىۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِى ٱلظَّـٰلِمِينَ,
স্মরণ করো যখন ইব্রাহিমকে তাঁর রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উতরে গেলো, তখন তিনি বললেন: “আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করব।“
বিশ্ব নেতৃত্ব পদে মনোনিত হয়ে ইব্রাহিম (আ.) এবার বিশ্বময় তাওহীদের বাণী পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের ছেলে লুত (আ.) কে ‘সামুদ‘ কনিষ্ঠপুএ ইসহাক (আ.) কে কেনানে বা ফিলিস্তিন এবং জ্যেষ্ঠ পুএ ইসমাইল (আ.) কে হিজাযের মক্কা নগরীতে পাঠালেন।
ইব্রাহিম (আ.) দীর্ঘদিন ইসমাঈল (আ.) এর সাথে অবস্থান করে মক্কায় ইসলামের শিক্ষা বিস্তার করেন এবং এখানেই পিতা–পুএ মিলে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশে বিশ্ব মুসলিমের প্রাণ কেন্দ্র “Head Quarter” বানিয়ে কাবা নির্মাণ করেন।
আর তখন আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম (আ.) নির্দেশ দেন ২২: আল–হাজ: আয়াত: ২৭
وَأَذِّن فِى ٱلنَّاسِ بِٱلْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالاً وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ,
লোকদেরকে হজের জন্য হুকুম দিয়ে দাও, তারা প্রত্যেকে দূর–দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে ও উটের পিঠে চড়ে কাবা তে আসে।
তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তখন থেকে অদ্যবধি বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক (হাজির, হে আমার রব আমি হাজির) “ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে প্রতি বছর মুসলিমগণ কাবা তে ছুটে আসেন। এভাবেই কাবা এবং হজ ইসলাম ও তাওহীদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইব্রাহিম (আ.) এর ইন্তেকালের পর ক্রমান্বয়ে তাঁর জাতি তাঁর শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে আবারো শিরকে লিল্প হতে শুরু করে এবং তাওহীদের মূল কেন্দ্র কাবাকে শিরকের আখড়ায় পরিণত করে। কাবা ঘরে ৩৬০ মূর্তি স্হাপন করে সেগুলো কে পূজা করতে থাকে।
ইব্রাহিম (আ.) কাবা নির্মাণের সময় যে সকল দোয়া করেছিলেন তার অন্যতম হলো আল–বাক্বারাহ: আয়াত: ১২৯
رَبَّنَا وَٱبْعَثْ فِيهِمْ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ ءَايَـٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَـٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ
হে আমাদের রব! এদের মধ্যে স্বয়ং এদের জাতি পরিসর থেকে এমন একজন রসুল পাঠাও যিনি এদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, এদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং এদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করবেন। অবশ্যই তুমি বড়ই প্রতিপত্তিশালী ও জ্ঞানবান।
তাঁর দোয়া প্রতিফল ছিল –সবশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবুয়াত লাভ করেন। তখন সমাজে মানুষ শিরকে লিপ্ত ছিল। তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকার মূর্তি পূজা করতে থাকে এবং ইব্রাহিম (আ.) এর তাওহীদের শিক্ষা একবারেই ভুলে যায়। মুহাম্মদ (স.) তাদেরকে শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহ ইবাদতের দিকে আহ্বান করেন। কিন্তু তাঁর জাতি তাঁর সাথে তেমন আচরণই করে যেমনটা আচরণ করেছিলো ইব্রাহিম (আ.) জাতি। আরবের মুশরিকরা একারণে মুহাম্মাদ (সা.)এর সাথে চরম নিষ্ঠুর আচরণ ও বর্বর নির্যাতন করে। পাথর মেরে তাঁর দেহকে রক্তাক্ত করে দেয়, কত নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দ্বীনের পথে অটল অবিচল থাকেন তিনি। দীর্ঘ চড়াই–উৎড়াই এবং মুশরিকদের সাথে সংঘাত সংঘের পর মুহাম্মদ (সা.) বিজয় লাভ করেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের কে চরমভাবে পরাভূত করেন। তিনি ইব্রাহিম (আ.) এর প্রতিষ্ঠিত কাবা হতে মূর্তিগুলো অপসারণ করেন এবং সেখানে নির্ভেজাল তাওহীদের ভিত্তি পুন:স্হাপন করেন।
জাহলেী যুগে মুশরিকরা উলঙ্গ হয়ে কাবা জিয়ারত করত এবং কাবা চত্বরে অশ্লীল কথা বলত, বিভিন্ন অশ্লীলতা প্রদর্শন করত। তাছাড়া কাবাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কুসংস্কারও প্রচলিত ছিল। মুহাম্মদ (সা.) এগুলো মূলোৎপাটন করে ইব্রাহিমের ব্যবস্থার উপর হজ ও জিয়ারতকে পুনঃপ্রবর্তন করেন। এরপর থেকে কাবা ইব্রাহিম (আ.) এর সময়ের মত মুসলিম উম্মাহর প্রধান কেন্দ্র এবং হজ মুসলিম উম্মাহর বিশ্ব সম্মেলনে পরিণত হয়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلْبَيْتِ مَنِ ٱسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاًۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِىٌّ عَنِ ٱلْعَـٰلَمِينَ,
মানুষের মধ্য থেকে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন এই গৃহের হজ সম্পন্ন করে, এটি তাদের ওপর আল্লাহর অধিকার।
রাসুল (সা) বলেন: “কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়, আর দু–উমরাহ তার মধ্যকার গুনাহের কাফফারাহ স্বরূপ।“
মুসনাদে আহমদ হাদিস :৯৯৪১/৯৯৪২
وَإِذْ جَعَلْنَا ٱلْبَيْتَ مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَأَمْنًا وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبْرَٲهِــۧمَ مُصَلًّىۖ وَعَهِدْنَآ إِلَىٰٓ إِبْرَٲهِــۧمَ وَإِسْمَـٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِىَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلْعَـٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ,
আর স্মরণ করো তখনকার কথা যখন আমি এই গৃহকে (কাবা) লোকদের জন্য কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল গণ্য করেছিলাম এবং ইব্রাহিম যেখানে ইবাদাত করার জন্য দাঁড়ায় সে স্থানটিকে স্থায়ীভাবে নামাযের স্থানে পরিণত করার হুকুম দিয়েছিলাম। আর ইব্রাহিম ও ইসমাঈলকে তাকীদ করে বলেছিলাম, আমার এই গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূ’–সিজদাকারীদের জন্য পাক–পবিত্র রাখ।
প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্হান থেকে তাদের প্রার্থনার প্রধান কেন্দ্র কাবায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে তা পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য পুনরায় বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েন।
লেখক: জুনায়েদ আব্দুল্লাহ
শিক্ষার্থী
আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর
আফ/দীপ্ত নিউজ