আমাদের জীবনযাপনে কায়িক শ্রমের সুযোগ বড় কম। ফলে অল্পতেই এখন আমরা হাঁপিয়ে উঠি। কেউ কেউ করছেন ধূমপান। শরীরে জেঁকে বসছে হৃদ্রোগ। ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ উপলক্ষে এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত বিশেষ গোলটেবিল বৈঠকে জীবনযাপনের ধারার এই বিষয়গুলো উঠে আসে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব হার্ট দিবস। দিবসটি সামনে রেখে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয় ২৭ সেপ্টেম্বর। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন প্রতিবছর দিবসটি পালন করে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল: হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের যত্ন নিন (ইউজ ইউর হার্ট টু লাভ হার্ট)।
গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটির মহাসচিব এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান, ইউনাইটেড হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. ফাতেমা বেগম, কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তৌফিকুর রহমান এবং এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিপণন বিভাগের সহকারী পরিচালক বিনয় দাস।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হৃদ্রোগের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন প্রফেসর তৌফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন, ব্লকজনিত হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন ৪ থেকে ৬ শতাংশ, কেউ কেউ জন্মগতভাবেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এত বেশি নয়, যতটা ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশে। দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে হয়তো আগামী বছরে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এই রোগে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ বেশি জরুরি। তাই আমি বলব, সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।’
হৃদ্রোগের ঝুঁকি ও কীভাবে এই ঝুঁকি এড়িয়ে চলা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বর্তমান নাগরিক জীবনধারায় আমাদের কায়িক শ্রম নেই বললেই চলে। বসে বসে কাজ করা আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। ফলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন ডায়াবেটিস রোগী। ডায়াবেটিস রোগীর হৃদ্রোগের আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেক। এ ছাড়া অল্প বয়সেই অনেকে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্যান্য দেশে যেখানে সাধারণত ৬০ বছরের পর মানুষ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন, সেখানে আমাদের দেশে ৫০ থেকে ৫১ বছর বয়সীরাই এই রোগের ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছেন।’
হৃদ্রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে বক্তব্য দেন ডা. মো. খালেকুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে হৃদ্রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। যখন পরিবারের কেউ আক্রান্ত হন, তখন তাঁর চিকিৎসার ব্যয় বহন, সেবা–যত্ন একটা বোঝার মতো হয়ে যায়। তাই হৃদ্রোগ প্রতিরোধই জরুরি। ইদানীং শিশুরাও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। ভারী স্কুলব্যাগ, পড়ার চাপ, খাদ্যাভ্যাস, খেলতে না পারা এর বড় কারণ। শিশুদের জীবনযাত্রার পাশাপাশি বড়দের জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।
একটা সময় ধারণা ছিল হৃদ্রোগে বেশি আক্রান্ত হন পুরুষ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক নারীও এই রোগের শিকার হচ্ছেন। নারীদের এই রোগ প্রতিরোধে সচেতন করেন ডা. ফাতেমা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের নানি-দাদিরা এই রোগে কম আক্রান্ত হতেন। কিন্তু এখন ৪০ থেকে ৯০ শতাংশ নারীকেই ঘরের বাইরে কাজে যেতে হয়। নানা ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁদের। ফলে নারীদের হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। আবার জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, নারীরা হরমোন ট্রিটমেন্টের মধ্য দিয়ে যান। এটাও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এই রোগ প্রতিরোধের একটাই উপায়—জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন। নারীদের নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করতে হবে। নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে।’
বৈঠকে সমাপনী বক্তব্য দেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিপণন বিভাগের সহকারী পরিচালক বিনয় দাস। তিনি বলেন, ‘আলোচনায় বারবার প্রতিরোধের বিষয়টিই উঠে এসেছে। প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতার উদ্যোগ নিই। আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেটা বলব, আমাদের দেশে এই রোগের অনেক সুচিকিৎসক আছেন। তাঁদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করি। আর যেহেতু আমাদের প্রধান কাজ ওষুধ তৈরি করা, বিশ্বের উন্নত দেশের মান অনুযায়ী আমরা আমাদের দেশের মানুষের জন্য ওষুধ তৈরি করে থাকি।’