৮ এপ্রিলের সকালটা ছিল অন্য যেকোনো দিনের মতোই। সিঙ্গাপুরের রিভার ভ্যালি রোডে নির্মাণকাজে ব্যস্ত ছিলেন ৩৫ বছর বয়সী বাংলাদেশি শ্রমিক শাকিল মোহাম্মদ। কিন্তু হঠাৎ এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তিনি প্রমাণ দিলেন অনন্য এক মানবিকতার। বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতায় সবার কাছে নায়ক বনে গেলেন তিনি।
নির্মাণ কাজ করতে করতেই হঠাৎ শাকিল দেখলেন, কাছের একটি দোকানঘরে আগুন লেগেছে। আগুন তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর ভবনের তৃতীয় তলার একটি কর্নারে আটকে আছে কয়েকটি শিশু। আতঙ্কে কাঁপতে থাকা শিশুরা নিচে লাফ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখনই নিজের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে গেলেন শাকিল। সঙ্গে নিলেন নির্মাণসাইটের একটি লম্বা মই। তার এক সহকর্মীকে নিয়ে উপরে উঠে শিশুদের নিচে নামাতে শুরু করলেন, এক এক করে শিশুদের বুকে জড়িয়ে নিচে নামিয়ে আনলেন নিরাপদে।
‘একটা মেয়ে ছিল একদম নিথর। সে নড়ছিল না। আগুনের তাপে শ্বাস নিতে পারছিলাম না, কিন্তু তখন ভাবিনি আমি বাঁচব কিনা—শুধু মনে হচ্ছিল, ওদের বাঁচাতে হবে।‘ সিঙ্গাপুরের ইংরেজি দৈনিক দ্য স্ট্রেইটস টাইমস–কে বলছিলেন শাকিল।
তিনি জানান, অন্তত ১০ জন শিশুকে তারা উদ্ধার করতে পেরেছেন। কিন্তু হৃদয়ে রয়ে গেছে দুঃসহ ক্ষত। তিনি বলেন, ‘ভবনের ভেতরে তখনো তিনজন শিশু ছিল। আমি ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আগুন ছিল ভয়ংকর রকম বড়। আমি এখনো ভাবলে কাঁদি; বাঁচাতে পারিনি ওদের।‘
অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১০ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান এক শিশু। আহত হন আরও ২১ জন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু।
শাকিলের এই বীরত্ব এখন কেবল এক ব্যক্তির গল্প নয়, তিন হয়ে উঠেছেন হাজারো মানুষের অনুপ্রেরণার প্রতীক।
স্থানীয় ব্যবসায়ী দানি রাহমাত বলেন, ‘এই বিদেশি শ্রমিকেরা যা করেছে, তা সত্যিকার অর্থে বীরত্ব। ওরা সাহস দেখিয়েছে, হৃদয় দিয়ে। ওরা আমাদের চোখে সত্যিকারের নায়ক।‘
সিঙ্গাপুরের Tomato Cooking School–এ আয়োজিত শিশুদের রান্না প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেই ঘটেছিল এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
সিঙ্গাপুর সিভিল ডিফেন্স ফোর্স (SCDF) ঘটনার পরদিন জানায়, শাকিল মোহাম্মদ এবং তার সহযোদ্ধাদের Community Lifesaver Award প্রদান করবে তারা।
শাকিল সিঙ্গাপুরে কাজ করছেন ২০১৮ সাল থেকে। তার পরিবার থাকে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পরিবারে রয়েছে– বৃদ্ধ বাবা–মা, স্ত্রী এবং দুই সন্তান।
শাকিল জানান, তিনি কখনো ভাবেননি যে একদিন এমন কোনো ঘটনায় জড়িয়ে যাবেন যা তাকে সংবাদপত্রের শিরোনামে পরিণত করবে। কিন্তু সেই সাধারণ মানুষটিই আজ এক অসাধারণ বীর।
যে দেশে তিনি প্রবাসী, সে দেশের শিশুর জীবন রক্ষায় নিজের প্রাণের পরোয়া না করে এগিয়ে গেছেন—এটাই মানবতার প্রকৃত উদাহরণ।