সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর সমন্বিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন জেলার শেরপুর উপজেলায় অবস্থিত ‘খেরুয়া মসজিদ’। সুলতানি ও মুঘল আমলের নকশার মিশেলে তৈরি এ মসজিদের বয়স প্রায় ৪৪৩ বছর। মুসলিম স্থাপত্যের যে ক’টি নিদর্শন বাংলায় দেখা যায়, এটি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটিতে আজও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন এলাকার মুসল্লিরা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, মসজিদের নির্মাণ শৈলীর পাশাপাশি মসজিদটি সম্পর্কে প্রচলিত নানা জনশ্রুতি এর আকর্ষণ আরও বাড়িয়েছে।
বগুড়া শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলার খন্দকারটোলা গ্রামে মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদের গায়ে থাকা শিলালিপিতে জানা যায়, ১৫৮২ সালের ২১ জানুয়ারি (৯৮৯ হিজরির ২৬ জিলহজ্জ) মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সঠিক তারিখ সংবলিত এ অঞ্চলে মুসলিম আমলের সবচেয়ে প্রাচীন কীর্তি এটি। আরব দেশ থেকে আব্দুস সামাদ ফকির নামে এক ব্যক্তি শেরপুরের এ এলাকায় এসেছিলেন। এলাকাটি ঘনবসতি হওয়ায় তিনি এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তখন এ অঞ্চলের শাসক জওহর আলী কাকশালের পুত্র মীর্জা মুরাদ খানের সহায়তায় মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
খেরুয়া মসজিদের গায়ে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, মসজিদের নির্মাণ কাজ ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়। এ মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ করতে আরও কয়েক বছর সময় লেগেছিল বলে ধারণা করা যায়। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয়, তাতে বিহার ও বাংলা সাময়িকভাবে সম্রাটের হস্তচ্যুত হয়।
সে সময় কাকশাল উপাধিধারী তুর্কী জায়গীরদারদের অধীনে ছিল ঘোড়াঘাট অঞ্চল। তারাও বিদ্রোহী হয়ে মাসুম খান কাবুলীর সাথে যোগদান করেন। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে খান–ই–আযম বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হয়ে নানারকম প্রলোভনে ভুলিয়ে কাকশাল নেতাদের বশীভূত করেন। এতে বিদ্রোহী মাসুম খান কাবুলি কাকশালদের ওপর প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে তাদের আবাসস্থল ঘোড়াঘাট আক্রমণ ও অবরোধ করেন। পরে খান–ই–আযম প্রায় চার হাজার অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়ে কাকশালদের বিপদমুক্ত করেন।
এতে দেখা যায়, ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের কাজ আরম্ভ হওয়ার সময় মসজিদ নির্মাতা নওয়াব মীর্জা মুরাদ খান বিদ্রোহীদের দলভুক্ত ছিলেন। পরবর্তী বছরে অন্যান্য কাকশাল নেতার সঙ্গে তিনিও সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করেন বলে জনশ্রুতি আছে। মীর্জা মুরাদ খানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি শেরপুর মোর্চার জায়গীরদার বা ফৌজদার ছিলেন বলে ধারনা করা হয়। এ সময়ে শেরপুর মোর্চা ঘোড়াঘাটের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন এই মসজিদটি টিকে আছে চার কোণের প্রকাণ্ড আকারের মিনার আর চওড়া দেওয়ালে ভর করে। উত্তর–দক্ষিণে লম্বা মসজিদটির বাইরের দিকের দৈর্ঘ্য ৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ২৪ ফুট। ভেতরের দিকের দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১২ ফুট। আর মসজিদের চারিদিকের দেওয়ালের পুরুত্ব ৬ ফুট।
এই মসজিদ নির্মাণে ইট, চুন ও শুড়কি ছাড়াও বৃহদাকার কৃষ্ণ পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের চারকোনায় চারটি মিনার ও পূর্ব দেওয়ালে তিনটিসহ উত্তর–দক্ষিণে আরও দুটি দরজা রয়েছে। আর পশ্চিম দেওয়ালে আছে তিনটি কারুকার্য করা মেহরাব। এছাড়া ধনুকের মতো বাঁকা কার্নিশের তলায় সারিবদ্ধ খিলান আকৃতির প্যানেলের আছে চমৎকার অলংকরণ।
ইটের বিন্যাস ও খাড়া প্যানেলের মাধ্যমে নান্দনিক বৈচিত্র্য তৈরি করা হয়েছে। মিনার, গম্বুজ ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি এবং ফুল–লতা–পাতার নকশা পুরো মসজিদটিকে দিয়েছে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। মসজিদের সামনের দেওয়ালে স্থাপিত হয়েছে ফার্সি শিলালিপি।
এই শিলালিপিতে খোদাই করা কথাগুলোর বাংলা তরজমা করলে কিছু আধ্যাত্মিক শক্তির কথা জানা যায়। যেমন– আবদুস সামাদ ফকির তিনি কবুতরদের সাথে কথা বলতেন। মসজিদ নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণের সময় দুটো কবুতর এসে মাটিতে নামে। তারা ও তাদের পরবর্তী বন্ধুদের মসজিদে বসবাসের জন্য আবদুস সামাদ ফকিরের কাছে স্থান দাবি করে। এই শিলালিপিতে তাই কবুতরদের বসবাসের জন্য নির্দেশনা উল্লেখ করা আছে। সেই সাথে তাদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য সতর্কবানীও দেয়া হয়।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে নিয়োজিত খেরুয়া মসজিদের কেয়ারটেকার আবদুস সামাদ প্রামাণিক এই মসজিদে ১৯৮৮ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জানান, মসজিদ প্রাঙ্গনে আবদুস সামাদ ফকিরের কবর রয়েছে। তবে তার মৃত্যুর দিনক্ষণ জানা যায়নি।
আবদুস সামাদ প্রামাণিক বাসসকে বলেন, আব্দুস সামাদ ফকির অনেক কামেল ব্যক্তি ছিলেন। তার সঙ্গে কবুতর কথা বলতো। মঙ্গলবার এই মসজিদ বানানোর জন্য ভিত্তি দেয়া হয়। মসজিদ বানানোর আগে দুটো কবুতর তাকে বলে, আপনি মসজিদ বানাচ্ছেন আমাদেরও ইবাদত করার জায়গা দেন। তখন তিনি বলেন, না তোমাদের জায়গা দিলে নানা অসুবিধা হবে। এরপরেও আলোচনার পর কবুতরদের মসজিদের দক্ষিণ উত্তর ও পশ্চিম এই তিন পাশে থাকার জায়গা করে দেন। এরপর সেখানে নামাজ আদায় হতো। এই কথা মসজিদের শিলালিপিতে লেখা আছে। এখন অবশ্য মসজিদে কোনো কবুতর থাকে না। কবুতরগুলো শাহজাদপুরে চলে গেছে। তার জায়গায় সারক (শালিক) পাখি বাস করছে।
জনশ্রুতি
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই মসজিদকে ঘিরে জনশ্রুতি আছে যে, এক রা_তে জ্বিন এই মসজিদ নির্মাণ করেছে। শিলালিপিতে কবুতরদের বাস করার নির্দেশনা এই জনশ্রুতিকে আরও বেশি যেন টেকসই করেছে। ফলে মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে যেমন শ্রদ্ধার, তেমনি ভয়ের স্থান। দীর্ঘদিন এই মসজিদ
এলাকাটি জঙ্গলে ভরপুর ছিল। ১৯৫৬ সালে মসজিদটি সরকারিভাবে পুরাকীর্তি হিসেবে মেরামত করা হয়। পরবর্তীতে মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা হয়।
এখনও মসজিদটি ব্যবহারের উপযোগী হলেও সেই ভয় থেকে অনেকে এখনও খেরুয়া মসজিদে নামাজ পড়তে ভয় পান।
খন্দকার টোলা গ্রামের আমজাদ হোসেন বলেন, এই মসজিদের অনেক বয়স, প্রায় সাড়ে চারশ বছর। আগে এখানে কেউ আসতো না। নামাজ পড়তো না। আমরা দাদা–বাবার কাছে শুনেছি এই মসজিদে জ্বিন–পরিরা নামাজ পড়তেন। এখন অবশ্য এখানে নামাজ হয়। ঈদের নামাজও পড়তে আসে মানুষজন। কিন্তু আমরা আসি না।
একই গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, আমরা গল্প শুনেছি এই মসজিদের গায়ে অনেক দামি দামি জিনিসপত্র ছিল। এই যেমন স্বর্নখচিত বা তেমন কিছু। কিন্তু কালক্রমে সেগুলো চুরি হয়ে যায়। আমরা তো দাদা–বাবার কাছে শুনেছি মসজিদ নির্মাণের সময় জ্বিনেরা ছিল। বিশ্বাস না করাও ঠিক হবে না। যেহেতু আমরা দেখিনি। হয়তো হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।
তবে এমন জনশ্রুতির বিষয়টি পুরোটাই ভিত্তিহীন বলেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কেয়ারটেকার আব্দুস সামাদ প্রামাণিক বলেন, এটা ভুয়া কথা। মানুষের হাতে মসজিদ বানানোর বিষয়টি তো শিলালিপিতে বর্ণনা করা আছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদটি এখন সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন। রাস্তাসহ ৫৯ শতক জায়গা নিয়ে অবস্থিত খেরুয়া মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে আয়তাকার মাঠ আর মসজিদের চতুর্দিকে রয়েছে তাল, নারকেল, আম এবং কদমগাছের সারি। মসজিদের উত্তরপাশে অজুর স্থান। ছাদের দিকে ছোট খোপগুলোয় শালিক পাখির আনাগোনা। বিকেল হতেই কিছু দর্শনার্থী চলে এসেছেন ঐতিহাসিক মসজিদ ঘুরে দেখতে।
মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন। তবে শুক্রবার ও শনিবার বেশি হয়। ওই দুদিনে ১৫০ থেকে ২০০ জন মানুষ আসেন খেরুয়া মসজিদ দেখতে।
শেরপুর উপজেলার ধুনট মোড় থেকে বান্ধবীদের নিয়ে বেড়াতে এসেছেন রোশনী আক্তারি। জানালেন, এখানে এসেছি ঘুরতে, ছবি তুলবো। আজকে ওয়েদার ভালো ছিল তাই এসেছি।
দীর্ঘদিন মসজিদটির সংস্কার হয়নি
২০১৮ সাল থেকে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্বে আছেন একই এলাকার জুবায়ের আহমেদ। নিজ এলাকায় ঐতিহাসিক একটি মসজিদে আজান দেয়ার দায়িত্ব পেয়ে যেমন খুশি তেমনি গর্বিতও তিনি।
জুবায়ের আহমেদ বাসসের সাথে আলাপকালে জানান, মসজিদের ভিতরে তিনটি কাতার হয়। প্রতি কাতারে ৩০ জন করে মোট ৯০ জন মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। শুক্রবার বাইরে কাতার করা হয়।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটির সংস্কার কাজ না হওয়ায় নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির দিনগুলোয় শুক্রবারের জামাতে মুসল্লীদের কষ্ট হয়। আবার মসজিদের ভিতরে বৃষ্টির সময় প্রচুর পানি পড়ে। পানি পড়ার কারণে এটি ধ্বংসও হতে পারে। এগুলোর দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান তিনি।
নামকরণ যেভাবে
এ মসজিদের ‘খেরুয়া‘ নামের কোনো ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়নি। আরবি বা ফারসি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ দেখা যায় না। তবে ফার্সি ভাষায় ‘খায়ের গাহ‘ (The interior of a house) বলে একটি শব্দ ‘কোনো স্থানের অভ্যন্তরে বা নিকটে’ অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এ মসজিদ যদি শেরপুর দুর্গের অভ্যন্তরে নির্মিত হয়ে থাকে তবে ‘খয়ের গাহ্‘ থেকে খেরুয়া নাম হওয়া বিচিত্র নয়।
বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ড. আহমেদ আবদুল্লাহ বাসসকে বলেন, বগুড়াকে বাংলার ইতিহাসের আকর হিসেবে ধরা হয়। তারই এক নিদর্শন শেরপুরের খেরুয়া মসজিদ। খেরুয়া মসজিদ সুলতানি আমলের শেষের দিকে আর মুঘল আমল শুরুর দিকে নির্মিত হয়। এটিতে সুলতানী আর মুঘলদের নির্মাণ শৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়।
তিনি বলেন, ফারসি ভাষায় ‘খেরুয়া’ বলে কোনো শব্দ নেই। ‘খায়ের গাহ’ শব্দ রয়েছে। ‘খায়ের গাহ’ বলতে বোঝায় ‘কোনো কিছুর নিকটে’। সেখান থেকে ‘খেরুয়া’ শব্দ এসেছে বলে ধারণা করা যায়।
মসজিদটির সংস্কার প্রসঙ্গে ড. আহমেদ বলেন, আসলে আমাদের দেশে ৬ হাজারেরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের জনবল ও আর্থিক অসংগতি রয়েছে। খেরুয়া মসজিদে বেশ কয়েকবার কাজ হয়েছে। হয়তো মাঝে কিছুদিন কাজ হয়নি। আমরা আগামীতে মসজিদের কি সমস্যা আছে সেদিকে নজর দেব।