নারায়ণগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিতে আহত হওয়ার পর, ১৭ বছর বয়সী ওয়ার্কশপ কর্মী মোহাম্মদ সিফাত ৩০ দিন ধরে শরীরে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় ছিলেন।
সিফাত সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চিকিৎসার জন্য আমাকে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ বা অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। বুলেটটি ১৮ আগস্ট পর্যন্ত আমার শরীরের ভেতরে ছিল, কারণ চিকিৎসকরা এটি শনাক্ত করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে তার শরীর থেকে বুলেট বের করার পর, সিফাতকে ২৪ আগস্ট রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে তিনটি ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যনালী ও একটি ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিফাত বলেন, ‘আমার ছাত্র ভাই–বোনদের যখন রাস্তায় নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, তখন এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ঘরে বসে থাকা আমার জন্য খুব কষ্টকর ছিল বলে গত ১৯ জুলাই জুম্মার নামাজের পর বন্ধুদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যাই’।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের ঝালকুঠি মোড়ে সাইনবোর্ড এলাকায় রাস্তায় নামার ৩০ মিনিটের মধ্যে দেখলাম বিজিবি ও পুলিশ আন্দোলনরত ছাত্র ও জনতাকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে, কিন্তু ছাত্ররা গোলাগুলির মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে।
দিনটিকে দুঃস্বপ্ন হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘লোকজনকে এখানে সেখানে গুলি করা হচ্ছিল এবং তারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বাম পা চেপে ধরে, আমার পাশের একজনকে চিৎকার করতে দেখলাম’। পরে আমি শুনেছি, ব্যক্তিটি মারা গেছে কারণ সে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল, খবরটি আমার জন্য খুবই মর্মান্তিক ছিল।
বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ঝালকুঠি মোড়ে সিফাতকে গুলি করে বিজিবি সদস্যরা।
সিফাত বলেন, ‘আমার বুকের বাম অংশে গুলি লাগার পর আমি ভেবেছিলাম ইটের টুকরো হবে, কিন্তু পরে বুঝতে পারি, এটি একটি বুলেট কারণ আমার পেট থেকে রক্ত বের হচ্ছিল এবং নালী ছিড়ে কিছু ভাত বের হচ্ছিল।
তিনি বলেন, ‘সেই সময়ে আমি অনুভব করেছি যে আমি আমার সমস্ত শক্তি হারাচ্ছি, এমনকি শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়েছিল এবং এভাবে আমার বন্ধুরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মুখে বাতাস দিয়ে জীবনসঞ্চার করছে। আমি ভেবেছিলাম, আমি নিশ্চিতভাবে মারা যাব কারণ আমি বিক্ষোভকারী এবং পুলিশের মাঝখানে আটকে ছিলাম।
পরে আমার বন্ধুরা কোনোভাবে একটি অটোরিকশা চালিয়ে এবং আমাকে একটি স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়’। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যান্ডেজটি খুলে আবার বন্ধ করে, আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে, যেখানে আমি অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে এবং অনেক ভাড়ার কারণে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম। “আমি এবং আমার বন্ধুরা ছয় হাজার টাকা ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স চায় সাত হাজার টাকা” একথা উল্লেখ করে সিফাত কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় আমাকে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় কারণ আমরা অতিরিক্ত এক হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হই, হঠাৎ একজন অজ্ঞাত মধ্যবয়সী নারী এগিয়ে এসে নগদ অর্থ সহায়তা দেন, যার ফলে শেষ পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, ‘ঢামেক হাসপাতালে শুরু থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে, তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হওয়ার পর, পরিস্থিতি ভালো হয়েছে’।
সিফাত বলেন, ‘যেদিন আমি গুলিবিদ্ধ হই সেদিন থেকে মেডিক্যাল লজিস্টিকসসহ যাবতীয় খরচ আমাদের নিজেদেরই বহন করতে হতো, যদিও শুনেছি ৭ আগস্টের পর যারা ভর্তি হয়েছেন শিক্ষার্থীদের চাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ভালো চিকিৎসা করছেন’।
তিনি বলেন, ‘আমার প্রধান উদ্বেগ ছিল আমার পরিবারের আর্থিক সংকট, কারণ প্রায় এক লাখ টাকা যার বেশিরভাগই ঋণ করা হয়েছিল আমার চিকিৎসা, খাবার ও অন্যান্য খরচসহ ব্যয় মেটাতে। আমার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস আমি এবং আমার বাবা যিনি রাস্তায় সিরামিক পণ্য বিক্রি করেন।
এজে/ আল/ দীপ্ত সংবাদ