শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪

সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অতীতের সব রেকর্ড ভাঙে। এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। এখন থেকেই যদি ডেঙ্গু প্রতিরোধে জোরালো ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তা হলে ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।

রবিবার (১৪ জুলাই) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বারসিক যৌথভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান ও করণীয় নির্ধারণশীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন

সভায় পবার সহসভাপতি জনাব হাফিজুর রহমান ময়নার সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পবার নির্বাহী সভাপতি বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী।

ধারণাপত্রে ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, ২০০০ সাল থেকে এদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ লক্ষণীয় হয়। ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু ঢাকাসহ মাত্র কয়েকটি বড় শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। সেসময় কেবলমাত্র আবাসিক এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক ছিল। এই উনিশ বছরে ডেঙ্গুজ্বরকে কেন নিয়ন্ত্রণ করা গেল না? সেসময় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক ভাবে সহজ ছিল। তখন প্রধান কাজ ছিল. আক্রান্ত শহরগুলোতে এডিস মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ করা, . আক্রান্ত রোগীকে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া এবং ৩. ডেঙ্গুঘন কেন্দ্র(Hotspot) গুলোতে সঠিক ব্যবস্থাপনা করা।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে সেসময়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুসমন্বিত কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দরকার ছিল মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটি সারাবছর জারি রাখা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরু হওয়ার পরই কেবল মশা মারার তোড়জোড় শুরু হয়। ডেঙ্গু রোগি কমতে শুরু করলেই কর্তৃপক্ষের মশক নিধন অভিযানে ভাটার টান দেখা দেয়। ফলে দিন দিন এডিস মশার উৎপাদন বাড়তে থাকে। এভাবেই ২০১৯ সালে ডেঙ্গু মহামারির পটভূমি প্রস্তুত হয়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু যখন মহামারি আকার ধারণ করেছে তখন কর্তৃপক্ষ এবং নানাভাবে সুবিধা ভোগকারী বেশকিছু নামকরা চিকিৎসাব্যক্তিত্বের মধ্যে অস্বীকার প্রবণতালক্ষ্য করা গিয়েছে। অর্থাৎ সেসময়ে তারা মহামারিকে অস্বীকার করে ডেঙ্গুর ব্যাপকতাকে কার্যত কম গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করার প্রয়াসে সচেষ্ট ছিল।

তিনি আরও বলেন, ২০১৯ এর মধ্য দিয়ে সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। দেশব্যাপি ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসাধারণকে যুক্ত করে একটি সুসমন্বিত কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা প্রনয়ণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। রাজধানীসহ বড় কিছু শহরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মশা মারার ঔষধ ছিটানো এবং ডেঙ্গুর হটস্পট ব্যবস্থাপনা করা হয়। কিন্তু দেশব্যাপী এসব পদক্ষেপ একত্রে গ্রহণ না করায় ২০২৩ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণের ভয়াবহ রূপ দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। ২০২৩ সালে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ডেঙ্গু আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭০৫ জন। অথচ তার আগের ২৩ বছরে এই সংখ্যা ছিল ৮৬৮ জন। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারি হিসাব অনুযায়ী ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগির সংখ্যা হচ্ছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৮ জন। পক্ষান্তরে কেবলমাত্র ২০২৩ সালেই ডেঙ্গু রোগির সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। বেসরকারি অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা মতে এই সংখ্যাগুলো আসলে কয়েকগুণ বেশি হবে। অন্য দিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষ ঢাকা কেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্ন। ঢাকার বাইরের অধিকাংশ স্থানের চিকিৎসা সেবার উপর আস্থাশীল হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ দ্বিধান্বিত।

আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক ব্যাধি শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, এডিস মশাকে ধোঁয়া ও মেডিসিন দিয়ে নিধন করার চিন্তা করলে হবে না। এডিস ও কিউলেক্স মশা এক নয়। এডিস মশা নিধনে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। অথচ এটি নির্ধারণে সিটি করপোরেশনের পর্যাপ্ত কিটতত্ত্ববিদ নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মিত ল্যাব নেই। এভাবে মশা নিধন সম্ভব নয়। রোগী শনাক্তের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু শহর ছেড়ে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পরেছে। অথচ সেখানে শনাক্ত ও চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা নেই। এ অবস্থায় ম্যালেরিয়ার মতো রেপিড টেস্টের মাধ্যমে গ্রামে ডেঙ্গু শনাক্তকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সাম্প্রতিক যে গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে তা প্রতিরোধমূলক নয়।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশা এখন আর নগরের মশা নেই। সে এখন তার রাজত্ব সারাদেশে ছড়িয়েছে। এজন্য পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অন্য প্রাণী দিয়ে তা নিধন করতে হবে। কিন্তু আমরা তা ধ্বংস করে দিয়েছি। এখন ফড়িং খুঁজে পাওয়া দায়। ফলে আমরা মশা মারতে কীটনাশক ব্যবহার করেছি। এটা ক্ষতিকর।

ডেঙ্গুর আর্থিক ক্ষতির তথ্য তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসায় জটিল অবস্থায় আমরা হাসপাতালে ভর্তি হই।আমাদের টেস্ট ও চিকিৎসা বাবদ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি এসময় কাজে যেতে পারেন না। ফলে এখানেও কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আবার সরকারও এখানে অনেক ভর্তুকি দিচ্ছে। যা সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আগামী ৫বছরের যে পরিকল্পনাটি করা হচ্ছে সেখানে ডেংগু নিরাময় ও চিকিৎসার জন্য যথাযথ বরাদ্ধ রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

বারসিকের পরিচালক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পাভেল পার্থ বলেন, রাষ্ট্রের অবহেলার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা পরিবেশ ধ্বংস করেছি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে পবা ও বারসিকের কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়:

. মশা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে কেন্দ্রীয় ভাবে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনসাধারণকে যুক্ত করতে হবে।

. মশক নির্মূলে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ, জিনগত নিয়ন্ত্রণ এবং জৈব নিয়ন্ত্রণ/ বায়োলজিকাল কন্ট্রোলের যুগপৎ এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী/ প্রয়োজনভিত্তিক প্রয়োগ করা।

. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর, পরিবেশবান্ধব মশাবিধ্বংসী ঔষধ প্রয়োগ করা।

. স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে পাড়া মহল্লায় সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা। এই কমিটি ডেঙ্গু, করোনা ইত্যাদি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে জাতীয় গাইডলাইন অনুযায়ী ভূমিকা রাখবে। প্রয়োজনে তাদেরকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

. সারাদেশে পরপর তিনদিন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে মানুষের বাড়িঘর এবং আশেপাশের ঝোপঝাড়ে এডিস মশার প্রজননস্থল ও বাসস্থান বিনষ্ট করতে হবে। একইসাথে মশা মারার ঔষধ ছিটানো হবে। একটি বাড়ি বা অফিসও বাদ যাবে না।

. প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা প্রতিটি বাড়ির বাসিন্দাদের এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে নিয়মিত সহযোগিতা করবে।

ডেঙ্গু রোগির চিকিৎসায় করণীয় হচ্ছে

. প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেঙ্গুর অ্যান্টিজেন পরীক্ষা সহজলভ্য এবং বিনামূল্যে করতে হবে।

. উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগির সুচিকিৎসার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা।  ঢাকা কেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষ যাতে স্থানীয় চিকিৎসা সেবার উপর আস্থাশীল হয় সেজন্য কর্তৃপক্ষকে যত্নবান করা।

.রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী ডেঙ্গু রোগির চিকিৎসা নিশ্চিত করা।

. ডেঙ্গু মোকাবেলায় সর্বস্তরের প্রস্তুতি রাখা।

. স্কুলগামী শিশুদের জন্য জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি  কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন দ্রুত আনার ব্যবস্থা করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৬১৬ বছরের শিশুদের জন্য এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন ২০২৩ সালে প্রদান করেছে।

. প্রতিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালকে আইনি বাধ্যকতার আওতা আনা যেন প্রতিটি ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীর তথ্য সঠিক সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার সংস্থাকে জানানো হয়।

নগর গবেষক ও বারসিকের সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম সভায় উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন

/ দীপ্ত সংবাদ

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More