প্রতিটি মা–বাবার কাছে তার সন্তান এক অমূল্য সম্পদ। তাকে একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবন উপহার দেওয়াই সকলের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। সন্তানের এই বেড়ে ওঠার পথে অভিভাবক হিসেবে আপনাকে অনেক ছোট–বড় বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো—আপনার সন্তান কী ধরনের খেলাধুলা করছে।
আমাদের মুরুব্বিরা একটি কথা প্রায়ই বলতেন—‘খেলায় বাড়ে, খেলায় পড়ে।‘ এই প্রবাদের অর্থ অত্যন্ত গভীর। সঠিক খেলা যেমন শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সাহায্য করে, তেমনই ভুল বা ক্ষতিকর খেলা তার সুন্দর ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
আপনার সন্তানের বেড়ে ওঠা যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সচেতনতা জরুরি। এই লেখায় আমরা এমন সাতটি খেলা নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনার সন্তানের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং যা থেকে তাকে অবশ্যই দূরে রাখা উচিত।
১. খেলনা বন্দুকের সহিংসতা
অনেক অভিভাবক শখ করে বা সন্তানের বায়না মেটাতে খেলনা বন্দুক কিনে দেন। কিন্তু এই আপাত নিরীহ বস্তুটি শিশুর মনে সহিংসতার বীজ বপন করে। বন্দুক নিয়ে খেলার মাধ্যমে শিশুর মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি হয়, যা বড় হওয়ার পরেও তার আচরণে থেকে যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অফলাইনে বা অনলাইনে বন্দুক নিয়ে খেলা শিশুদের মধ্যে সহানুভূতিশীলতা (Empathy) তৈরির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এটি একটি শিশুর সামাজিক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
২. ভয় দেখানো খেলার মানসিক ক্ষতি
শিশুদের সঙ্গে অন্ধকারে লুকোচুরি, ভূতের গল্প বা প্লাস্টিকের সাপ, মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখানোর মতো খেলাগুলো একেবারেই অনুচিত। এই ধরনের খেলা থেকে শিশুর মনে যে ভয়ের সৃষ্টি হয়, তা পরবর্তীতে কাটানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
এর ফলে শিশুর ঘুমে সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা, অন্ধকারে ভয় পাওয়া এবং কাল্পনিক ভূতের ভয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়। এই ভয়গুলো তার স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৩. বাজি ধরে খেলার জুয়াড়ি মনোভাব
কোনো রকম বাজি বা পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে শিশুকে লুডু, ক্যারাম বা অন্য কোনো খেলায় উৎসাহিত করবেন না। এই ধরনের খেলা শিশুর মধ্যে অল্প বয়সেই লোভ তৈরি করে এবং তাকে পরিশ্রমের পরিবর্তে ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল করে তোলে, যা ভবিষ্যতে তাকে জুয়ার মতো সর্বনাশা নেশার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এক্ষেত্রে পরামর্শ হলো: ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দিন, কিন্তু পুরস্কার বা বাজি নির্ভর খেলাকে উৎসাহিত করবেন না।
৪. ‘ডেয়ার গেম’–এর মারাত্মক ঝুঁকি
‘ডেয়ার গেম’ মানে হলো এমন কোনো খেলা যেখানে শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ করতে চ্যালেঞ্জ করা হয়। যেমন: ‘দেখি তো কতক্ষণ দম বন্ধ করে রাখতে পারো?’ অথবা ‘সোফা থেকে লাফ দাও তো দেখি’। শিশুকে সাহসী বানানোর নামে এ ধরনের খেলা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এই খেলাগুলো শিশুকে সাহসী করার বদলে গুরুতর শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। মনে রাখবেন, প্রকৃত সাহস ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নয়, বরং নিরাপদ ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে প্রকাশ পায়।
৫. অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক খেলার হীনমন্যতা
বাড়িতে ভাইবোন বা বন্ধুদের সঙ্গে খেলার পরিবেশটি হওয়া উচিত আনন্দময়, প্রতিযোগিতামূলক নয়। এমন কোনো খেলা খেলতে দেওয়া উচিত নয়, যেখানে হেরে গেলে শিশু নিজেকে অপমানিত বা ছোট মনে করে। বাড়িতে খেলার ছলে বারবার হারার অভিজ্ঞতা শিশুর আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয় এবং তার মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করে।
মূল কথা হলো: “বাচ্চাদের খেলায় ফান থাকুক—কম্পিটিশন নয়।” বাড়ির খেলার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সম্মিলিত আনন্দ, যেখানে হার–জিতের চেয়ে অংশগ্রহণই মুখ্য।
৬. দম বন্ধ করার খেলা: যেখানে মৃত্যুও হতে পারে
অনেক সময় শিশুরা খেলার ছলে একে অপরের বুক চেপে ধরে বা মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মজা করে। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি খেলা। এই ধরনের খেলায় শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
এর ফলে শিশু অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তাই এই ধরনের খেলা থেকে আপনার সন্তানকে কঠোরভাবে বিরত রাখুন।
৭. ভিডিও গেমের সর্বনাশা আসক্তি
উপরে আলোচিত সব খেলার চেয়েও সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো ভিডিও গেমের আসক্তি। এর আকর্ষণ এতটাই তীব্র যে শিশুরা খুব সহজেই এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই আসক্তিকে ‘গেমিং ডিসঅর্ডার’ (Gaming Disorder) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভিডিও গেমের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি শিশুর চিন্তা করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, পড়ালেখায় মনোযোগ নষ্ট করে এবং তাকে খিটখিটে মেজাজের করে তোলে। এর ফলে ঘুমের সমস্যা তৈরি হয় এবং শিশু ধীরে ধীরে অসামাজিক হয়ে পড়ে।
শিশুর খেলাধুলা কোনো সাধারণ বিষয় নয়, বরং তার ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব হলো ক্ষতিকর খেলাগুলো চিহ্নিত করা এবং সন্তানকে সচেতনভাবে সৃজনশীল ও স্বাস্থ্যকর খেলার জগতে উৎসাহিত করা। আপনার সন্তানকে আসক্তিমুক্ত নির্মল শৈশব উপহার দিতে, এই ক্ষতিকর খেলাগুলোকে আজই ‘না’ বলুন। সবশেষে, একটি কথা সবসময় মনে রাখা প্রয়োজন, শিশুর সামান্য ক্ষতি মানে পৃথিবীর অনেক বড় ক্ষতি।
বাদল সৈয়দ, লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
মাসউদ/এসএ