দেশে আরও উৎপাদনশীল কর্মশক্তি গড়ে তোলা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো এবং মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যকার ব্যবধান দূর করার জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন এক গোলটেবিল আলোচনার বক্তারা।
বুধবার (২২ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে সাজেদা ফাউন্ডেশন আয়োজিত “শ্রেণিকক্ষ থেকে ক্যারিয়ার: বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে সমৃদ্ধিকরণ” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ আহ্বান জানান তারা।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যকার ব্যবধান দূর করার জন্য বক্তারা কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাত থেকে উদ্ভাবনী তহবিল ও আনুষঙ্গিক সহায়তা প্রদানের পরামর্শ দেন।
আলোচনায় সভাপতিত্বকালে সাজেদা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন সাবেক কূটনীতিক ফারুক সোবহান বলেন, শুধুমাত্র শিক্ষার নিম্নমানের কারণে বাংলাদেশ অনেক দেশের থেকে পিছিয়ে পড়েছে, যাদের অর্থনীতি একসময় বাংলাদেশের তুলনায় দুর্বল ছিল।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একসময় এশিয়ার চারটি দেশ – চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম – থেকে এগিয়ে ছিল কিন্তু সবগুলো দেশ আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। তাদের অগ্রগতির মূল কারণ হলো শিক্ষা। এটি ছিল মানসম্মত শিক্ষা এবং সকলের জন্য শিক্ষা।”
“আমরা বাংলাদেশে এটি করতে পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা আমাদের অতিক্রম করতে হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য আমাদের একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে,” একথা উল্লেখ করে তিনি মানসম্মত শিক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে শিক্ষাকে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দেন সরকারি নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ ও উন্নয়ন অংশীদাররা।
সাজেদা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদা ফিজ্জা কবির তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, বিশ্বের অন্যতম তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, “আমাদের যুবসমাজ আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হবে যখন আমরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও মানসিকতা দিয়ে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলতে পারি। যদি শিক্ষা আজকের বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে না চলে, তাহলে আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনমিতি লভ্যাংশ) সহজেই বোঝায় পরিণত হতে পারে।”
খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সাল খান ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। তিনি শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণে প্রযুক্তির রূপান্তরকারী শক্তির উপর জোর দেন। তিনি বলেন, “যখন শিক্ষার্থীদেরকে উচ্চমানের শিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয় এবং শিক্ষকদেরকে নিজস্ব ধারায় শিক্ষা প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখন ব্যাপকভাবে রূপান্তর ঘটে। উদ্ভাবন, অন্তর্ভুক্তি ও শিক্ষকদের নিষ্ঠার সমন্বয়ের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা বাংলাদেশের রয়েছে।”
তিনি খান একাডেমির সাফল্যের প্রশংসা করেন এবং “স্থানীয় অংশীদারিত্ব এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা কীভাবে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে এটিকে তার একটি অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ” বলে অভিহিত করেন।
গোলটেবিল বৈঠকে ৩১টি পাইলট স্কুল ও ৫ হাজার ৩৪২ শিক্ষার্থীর উপর খান একাডেমি–পরিচালিত একটি পাইলট প্রকল্পের অগ্রগতি উপস্থাপন করা হয়, যেখানে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের শেখার দক্ষতা নয় গুণ এবং অংশগ্রহণ ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অগ্রগতি উপস্থাপন করার সময় খান একাডেমি বাংলাদেশের সিইও এবং সাজেদা ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজি লিড ফর এডুকেশন আজওয়া নাঈম বলেন, স্কুলের শিক্ষকরা এখন প্রতিটি শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রদানের জন্য উপাত্ত ও ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন। “ফলাফল থেকে দেখা যায়, রূপান্তর কেবল তখনই সম্ভব, যখন শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন করা হয় এবং সঠিক উপকরণ দিয়ে সহায়তা করা হয়,” যোগ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন–এর নির্বাহী পরিচালক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা চৌধুরী, প্রাইম ব্যাংক পিএলসির উপ–ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজিম চৌধুরী, আইডিএলসি ফাইন্যান্স পিএলসির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ সাদ বিন শামস, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন পিএলসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাজিথ মিওয়ানেজ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাদিয়া রশিদ, খান একাডেমির ব্যবস্থাপক (আন্তর্জাতিক কৌশল ও পরিচালনা) এমিলি গোল্ডম্যান, কাজী ফার্মসের পরিচালক জাহিন হাসান, নেসলের মানবসম্পদ পরিচালক হোসনে আরা লোমা, সরকারের এলএআইএসই প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক শিপন কুমার দাস, আগামী এডুটেক–এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর দিলরুবা চৌধুরী, আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ রিয়াদ এবং সাজিদা ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা শেহজাদ মুনিম এবং ডেপুটি সিইও মো. ফজলুল হক।
একবিংশ শতাব্দীর কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাত কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে সম্পর্কে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন আলোচনার অংশগ্রহণকারীরা। তারা গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষায় শক্তিশালী বুনিয়াদি শিক্ষার পাশাপাশি ডিজিটাল প্রস্তুতি, সুক্ষ্মচিন্তন, সমস্যা সমাধান এবং যোগাযোগ দক্ষতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
তারা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এখন পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে যাতে এটা নিশ্চত করা যায় যে, প্রতিটি তরুণ কেবল জ্ঞান নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করছে না; অর্থবহ ক্যারিয়ার গড়ে তোলার এবং জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাসও নিয়ে যাচ্ছে।