মেহেদী সুমন
জুলাই–আগস্টের ছাত্র ও জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি গণপিটুনি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যা জনমনে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।
তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট বিক্ষুব্ধ ও উদ্ভ্রান্ত জনমত বা গুজবে গা ভাসিয়ে, চোর–ডাকাত, অপরাধী বা বিগত সরকারের কর্মী–সমর্থক সন্দেহে কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে, যা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
গুজব বা জনমনে ক্ষোভের উদ্রেক কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। অতীতে দেশের আনাচে–কানাচে এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। চোর–ডাকাত–ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। বেশিরভাগ ঘটনায় মামলা হলেও দেশব্যাপী আলোচনায় না আসলে পুলিশের তেমন তৎপরতা থাকে না।
তাসলিমা বেগম রেণু নামে এক নারী ২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিজের সন্তানের স্কুলে ভর্তির তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, রেণু হত্যা মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি।
দেশের প্রচলিত আইন এবং সাংবিধানিক সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত ও বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে গণপিটুনির ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের শাস্তির নজির বাংলাদেশে খুবই বিরল। এ কারণেই গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দ্বিধান্বিত হয় না। অথচ, এটি আইন ও বিচারবহির্ভূত।
গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘মব জাস্টিস‘ বা তাৎক্ষণিক বিক্ষুব্ধ জনতার বিচারের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে অপরাধী মনে করে তাৎক্ষণিকভাবে গণপিটুনির মতো অপরাধমূলক ঘটনা ঘটানো আইনশৃঙ্খলার অবনতির চরম লক্ষণ।
দেশের জনগণ গত ১৬ বছরে শাসকদল ও তাদের সমর্থকদের দ্বারা নিগৃহীত ও নিপীড়িত হয়ে আসছিল। ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে অনেকেই সুযোগ সন্ধানী হয়ে মব জাস্টিসের নামে সহিংসতা ও গণপিটুনির মাধ্যমে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে বা নীচে নয়। জড়িতদের সামাজিকভাবে বয়কট এবং আইনের হাতে সোপর্দ করে এমন ঘটনার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
প্রশাসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পুনর্গঠন ধীরগতির কারণে দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা করছে। তাই পুলিশকে দ্রুত কার্যকর করে তোলা জরুরি।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়, সংবিধানের মৌলিক বিধান ও প্রচলিত বিচার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধভাবে শান্তি–শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক গণপিটুনির ঘটনায় হতাহতের ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫ আগস্টের পর থেকে বগুড়া, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, মিরসরাই, যাত্রাবাড়ী, টঙ্গী, রাজশাহী এবং বরিশালে গণপিটুনির ঘটনায় ২১ জন নিহত ও বহু মানুষ আহত হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বেশি। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শারীরিক প্রতিবন্ধী আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদের গণপিটুনিতে নিহত হওয়া ঘটনাগুলো নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল নামে একজনকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন জায়গা, যেখানে দেশের সেরা মেধাবীদের বিচরণ, যারা দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেখানে যদি গণপিটুনির শিকার হয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তাহলে দেশের অন্যপ্রান্তের অবস্থা কতটা শোচনীয় হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
কোনো ব্যক্তি চোর–ডাকাত বা অপরাধী হোক না কেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তার বিচার বা শাস্তি প্রদান করার অধিকার কারো নেই।
বাংলাদেশের সংবিধানে, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, রাজনৈতিক আদর্শ, সামাজিক অবস্থান এবং অপরাধী–নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে সমানভাবে আইনের আশ্রয় ও বিচার লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ–২৭ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, গণপিটুনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। মানবাধিকার ঘোষণার ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার আছে।‘
দেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন, নাগরিকের বিবেক ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে মব জাস্টিস একটি খুন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ, যা শাস্তিযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান এবং জুলাই গণ–আন্দোলনের শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মব জাস্টিসের মতো বেআইনি সহিংসতার সংস্কৃতি রুখতে হবে।
মব জাস্টিস বন্ধে আন্তঃমন্ত্রণালয় ‘এন্টি মব জাস্টিস সেল‘ তৈরি করে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের শান্তি–শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আল/ দীপ্ত সংবাদ