বিজ্ঞাপন
শনিবার, মে ১৭, ২০২৫
শনিবার, মে ১৭, ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্য ট্রাম্পের সফর: আলোচনায় কূটনীতি, উপেক্ষিত মানবাধিকার

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর গতানুগতিক বিষয়টিই যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখন কী বলবেন, কীভাবে বলবেন কিংবা তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে—সেসব অনুমান করা অনেক বিশ্লেষকের কাছে রীতিমত ‘অসম্ভব’।

নিজের মধ্যপ্রাচ্য সফরেও তিনি এ ধারা বজায় রেখেছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটিই তার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সফর। নিজের স্বভাব অনুযায়ী এ সফরকালেও তিনি আলোচনার বিষয়ে ভিন্ন পথেই হেঁটেছেন।

এর আগে পশ্চিমা নেতাদের মধ্যপ্রাচ্য সফরে মানবাধিকারের মতো বিষয় গুরুত্ব পেলেও কূটনৈতিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন ট্রাম্প; আর মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতেও মানবাধিকারের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে গেছেন তিনি।

মঙ্গলবার (১৩ মে) সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। সে সময় আরব উপসাগরীয় ধনী দেশগুলোতে অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেন তিনি।

ট্রাম্প বলেন, ‘এখন আর সেই দিন নেই যে আমেরিকান কর্মকর্তারা মধ্যপ্রাচ্যে উড়ে এসে আপনাদের শেখাবে—কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে, কীভাবে দেশ চালাতে হবে।’

অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সবচেয়ে ভালো সময় পার করছে রিয়াদ।

তবে সৌদির সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, ব্যবসায়ী, লেখকসহ দেশটি থেকে পালিয়ে যাওয়া আরও অনেকেই তার কথা শুনেছেন। তাদের মত অবশ্য ভিন্ন।

ট্রাম্পের এই ভূমিকাকে একপ্রকার অশনি সংকেত বলে মনে করছেন তারা। তাদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের এই বক্তব্য মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের অনিয়মিত বা অসম্পূর্ণ হলেও শক্তিশালী ভূমিকা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত বহন করে।

এ বিষয়ে যুবরাজ সালমানের শাসনামলের প্রথম দিকে জেলে থাকা এক আলেমের ছেলে আবদুল্লাহ আলআউধ বলেন, ‘তার (ট্রাম্প) এই ভূমিকা দেখা সত্যি বেদনাদায়ক ছিল।’

বিশ্বের নানা দেশের সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একপ্রকার একঘরে হয়ে পড়ার পর দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত করতে রাজপরিবারের শত শত সদস্য, নাগরিক সমাজের কর্মী, অধিকারকর্মীসহ অনেক বন্দিকে মুক্তি দেয় সৌদি প্রশাসন। তবে আবদুল্লাহর বাবা সালমান আলআউধ এখনও কারাবন্দি রয়েছেন।

হতাশ কণ্ঠে আবদুল্লাহ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই যুবরাজের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেছেন, যিনি কিনা আমার বাবাকে নির্যাতন করেছেন, আমাদের পরিবারকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।’

আবদুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রে থেকে সৌদি আরবে আটক ও বন্দি ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে থাকেন। এসব বিষয়ে সৌদি প্রশাসনের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলেও তারা সাড়া দেয়নি।

এদিকে, হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদির ক্রমবর্ধমান অংশীদারত্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির পথে অগ্রসর হওয়ার পদক্ষেপকে প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প।’ তবে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে মানবাধিকার বিষয়ে ট্রাম্প কোনো আলোচনা করেছেন কিনা, এ বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।

তবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র টমি পিগট বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের আলোচনা ছিল ব্যক্তিগত।’

মানবাধিকার ইস্যুতে কম গুরুত্ব

বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সফরে মানবাধিকার বিষয়ে যতটা গুরত্বের সঙ্গে আলোচনা হওয়া উচিৎ, ট্রাম্পের সফরকালে বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পায়নি।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, এসব দেশের পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

এমনকি ট্রাম্পের এবারের বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত নির্বাসিত সৌদি নাগরিকদেরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগের মতো সরব হতে দেখা যায়নি। তাছাড়া ট্রাম্প সৌদিতে বন্দি মার্কিন নাগরিক বা অধিকারকর্মীদের মুক্তির প্রসঙ্গ তুলেছেন কিনা, এ নিয়েও তেমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়নি তার প্রশাসন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্যে, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ার কারণে এমন নীরবতা দেখা যেতে পারে।

অনেকে আবার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের মানবাধিকারের বিষয়ে ট্রাম্পের এই নীরবতা।

ইব্রাহিম আলমাদি নামে ফ্লোরিডার এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমার বাবা সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক টুইটের জন্য কারাবন্দি হয়েছিলেন। তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাবাকে ফেরানোর জন্য রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা বা অন্য কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘ট্রাম্প আর যুবরাজ ভালোবাসার সম্পর্কে রয়েছেন। কেউ যদি একবার ট্রাম্পের কানে বাবার বিষয়টা দিতেন আর তিনি যুবরাজকে বলতেন, আমি নিশ্চিতভাবে বাবাকে ফিরে পেতাম।’ ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর: আলোচনায় কূটনীতি, উপেক্ষিত মানবাধিকার

সবার এই চুপ হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কী

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সৌদি নাগরিকরা এবার কেন এত চুপচাপ, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন তারা আর সেভাবে নিন্দা জানিয়ে কিছু লেখেন না—এই বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সবার নজর কেড়েছে।

এ বিষয়ে কয়েকজন প্রবাসী সৌদি নাগরিক জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের কারণে তারা আতঙ্কিত। ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ করায় যেভাবে কয়েকজনের ওপর খড়গহস্ত হয়েছেন ট্রাম্প, তাতে সৌদির বিষয়ে বা ট্রাম্পের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গেলে একই পরিণতির আশঙ্কা করছেন তারা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাংবাদিক জামাল খাসোগির প্রতিষ্ঠিত ‘ডেমোক্রেসি ইন অ্যারার ওয়ার্ল্ড নাউ’এর নির্বাহী পরিচালক সারাহ লিয়া হুইটসন এ বিষয়ে জানান, যুক্তরাষ্ট্রে অনিশ্চিত অভিবাসন পরিস্থিতিতে থাকা আরব নাগরিকদের তারা ভ্রমণের সময় সতর্ক থাকতে এবং চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

সাংবাদিক জামাল খাসোগি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের একজন কলামলেখক ছিলেন। তিনি সৌদিতে সংস্কার আনতে যুবরাজ সালমানকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে ২০১৮ সালে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, যুবরাজ নিজেই ওই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা তদারক করেছিলেন, যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন।

এ ঘটনার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি রাজপরিবারকে একঘরে করার অঙ্গীকার করেন। তবে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানির দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব সফর করেন বাইডেন। সে সময় যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাতও করেন তিনি।

তারপর ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে বড় বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের ধনীদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় আছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ছেলেরাও ওই অঞ্চলগুলোতে বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন।

সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি

খাসোগি হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও একঘরে হয়ে পড়ে রিয়াদ। এরপর নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার চাওয়া, সমালোচনামূলক টুইটকারী কিংবা সৌদির আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে আটক অনেককে নীরবে মুক্তি দেন যুবরাজ। এ ছাড়া, সৌদিতে ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ ও অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় করার প্রচারের অংশ হিসেবে নারীদের জন্য আইনগত ও সামাজিক শর্তও শিথিল করেন তিনি।

অবশ্য এখনও আলেমসহ হাজার হাজার মানুষ মানুষ কারাবন্দি ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার শিকার বলে জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

সারাহ লিয়া হুইটসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণেও এই সফরের সময় অধিকারকর্মীরা অস্বাভাবিকভাবে নীরব।

গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ১৯ মাসের অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় শুধু বহিষ্কার নয়, ইসরায়েলকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন হুইটসন। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, তারা যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

হুইটসন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে অন্য কোনো দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করলে তা হাস্যকর শোনায়। যুক্তরাষ্ট্রের এখন অন্য দেশকে তিরস্কার করার মতো নৈতিক অবস্থান, আইনি ভিত্তি বা বিশ্বাসযোগ্যতা—কোনোটিই নেই।’ সূত্র: ইউএনবি।

আরও পড়ুন

সম্পাদক: এস এম আকাশ

অনুসরণ করুন

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন

স্বত্ব © ২০২৩ কাজী মিডিয়া লিমিটেড

Designed and Developed by Nusratech Pte Ltd.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More