২০১৭ সালের ২ আগস্ট, বার্সেলোনাভক্তদের হৃদয়ে আজও দিনটি অমলিন হয়ে আছে। সেদিন লিওনেল মেসির উত্তসূরি হিসেবে যাকে ভাবা হচ্ছিল, সেই নেইমারই ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দেন। তারপর থেকে গুঞ্জন ছিল বিশ্বসেরা ফুটবলার হতেই মেসির ছায়া থেকে বের হতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে এত বছর পর সেইসব গুঞ্জনে জল ঢেলেছেন এই ব্রাজিলীয় তারকা।
সম্প্রতি ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার রোমারিওর একটি পডকাস্টে বার্সেলোনা ও পিএসজিতে থাকাকালে নিজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন নেইমার। ওই আলাপচারিতায় উঠে আসে তার বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গটি।
২০১৭ সালে ঠিক কী হয়েছিল, মেসি তোমার (পিএসজিতে) চলে যাওয়ার বিষয়টি কীভাবে নিয়েছিল?— রোমারিওর এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্রাজিলিয়ান প্রিন্স বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, বিশ্বসেরা ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছায় আমি বার্সেলোনা ছাড়িনি।’
‘বার্সায় আমার শেষ সপ্তাহে মেসি নিজেই আমাকে ডেকে বলেছিল— কেন চলে যাচ্ছ? কারণটি যদি এমন হয় যে, তুমি বিশ্বের সেরা ফুটবলার হবে, তাহলে আমিই তোমাকে বিশ্বসেরা বানাব।’
‘আমি মেসিকে বলেছিলাম যে, বিষয়টি তা নয়। এটি ব্যক্তিগত এবং তোমাকে নিয়ে আমার মধ্যে এমন কোনোকিছু নেই।’
পিএসজির বিরাট অঙ্কের আর্থিক প্রস্তাব যে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল, তা স্বীকার করে নেইমার বলেন, ‘ওদের প্রস্তাবটি বার্সেলোনায় আমি যা উপার্জন করতাম, তার চেয়ে অনেক বড় ছিল।’
‘তাছাড়া নতুন দলে (পিএসজিতে) বেশ কয়েকজন ব্রাজিলীয় ফুটবলার ছিল। সেখানে আগে থেকেই থিয়াগো সিলভা ছিল। দানি আলভেস মাত্রই যোগ দিয়েছে তখন, আর মার্কিনিয়োস ও লুকাস (মৌরা) আমার বন্ধু। আমি ওদের সঙ্গে খেলতে চেয়েছিলাম।’
‘নিজেকে বলেছিলাম, আমার চারপাশে কিছু ব্রাজিলীয় (ফুটবলার) চাই। বার্সায় এখন আর কোনো ব্রাজিলীয় নেই।’
নেইমারের কথায়, ‘মেসিকে আমি আরও বলেছিলাম— আমি যাচ্ছি, একটা চান্স নিয়েই দেখি। তবে বিশ্বসেরা হতে আমি তাকে (মেসি) ছেড়েছি, কথাটা ঠিক নয়।’
বার্সেলোনায় যোগ দেওয়ার পর একেবারে শুরুর দিকের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে আল–হিলাল তারকা বলেন, ‘প্রথম ৬ মাস এমন মনে হতো যে, আমার পেটে সবসময় প্রজাপতি উড়ছে। মনে হতো, হচ্ছেটা কী! কাউকে ড্রিবল করতে পারি না, একা একা বল নিয়ে এগোতে পারি না, কোনোকিছুই তো ঠিক হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! শুরুর দিকে খুবই হতাশ থাকতাম।’
‘আমি এখনও ভুলতে পারি না, আথলেতিক বিলবাউয়ের বিপক্ষে ম্যাচের বিরতির সময় আমি যখন ড্রেসিংরুমে ফিরি, নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে তখন খুবই হতাশ ছিলাম। এতটাই খারাপ লাগছিল যে, আমি ওয়াশরুমে গিয়ে কাঁদছিলাম এই ভেবে— কী খেলছি আমি?’
‘তখন কে যেন দরজায় টোকা দিল! নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে খুলে দেখি মেসি। ও বলল— কাঁদছ কেন? আমি বললাম— নাহ, কিছু না; ঠিক আছি।’
‘তারপর দানি (আলভেস) এলো এবং মেসি বলল— এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। তোমাকে সহযোগিতা করার জন্য আমরা তো আছিই। সান্তোসে যেভাবে খেলতে, অমন দারুণ ফুটবল যাতে খেলতে পার, তার জন্য আমরা তোমার পাশে আছি। কোনোকিছুর দরকার হলে আমাকে জানাতে সংকোচ করার প্রয়োজন নেই।’
‘তারপর থেকে আমি বেশ খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই এবং ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে।’
কিশোর বয়সে তো বটেই, ২০১৩ সালে বার্সেলোনা যখন নেইমারকে কাম্প ন্যুতে নিয়ে আসে, সেই সময়ও ভবিষ্যত অনুমান করে তরুণ নেইমারকে পেতে কম দৌড়ঝাঁপ করেনি রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু শেষমেষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার জার্সিই গায়ে চাপান নেইমার।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, “সেই দিনগুলি ছিল ভীষণ চাপের। দুই–তিন দিন তো আমি অনুশীলনও করতে পারিনি। দুই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আমাকে সমানে ফোন করে চলেছেন। কোথায় যাব—ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না। এমনকি আমি দুই ক্লাবেই খেলছি—আলাদা আলাদাভাবে এমন কল্পনাও করি। এরপর আমার মন বলল— বার্সেলোনাই আমার জন্য সঠিক জায়গা। রিয়ালকে ‘না’ বলায় আমি একটুও অনুতপ্ত নই।”
“বার্সা ছিল আমার ভালোবাসার ক্লাব। অবশ্যই মেসির সঙ্গে খেলতে চেয়েছিলাম। তবে রোনালদিনিয়োর সময় থেকেই আমি তাদের খেলা দেখতাম আর ভাবতাম— আমিও একদিন এই ক্লাবে খেলব আর সেটা হয়েছেও।”
পিএসজিতে যাওয়ার পর আসলে সেখানে সমস্যা কী হলো?— রোমারিওর প্রশ্নে জবাবে নেইমারের অকপট উত্তর, ‘অহংকার, অহংকার।’
‘আমার এখন মনে হয়, নিজেকে সেরা ফুটবলার দাবি করা— এমন অহংকার থাকাটা একেবারে মন্দ নয়, কিন্তু নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করা হচ্ছে কিনা, তা তোমাকে বুঝতে হবে।’
কিলিয়ান এমবাপ্পে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পর নেইমারের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।
এ প্রসঙ্গে নেইমার বলেন, “ওর সঙ্গে আমার কিছু সমস্যা হয়েছিল, আমরা একটু ঝগড়াও করেছি। তবে ও যখন প্রথম প্রথম এলো, তখন ওকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো। আমিও ওকে ‘গোল্ডেন বয়’ বলে ডাকতাম। আমি ওকে সবসময় বলতাম যে, একদিন ও সেরা খেলোয়াড় হবে। আমি সবসময় ওকে সাহায্য করতাম, কথা বলতাম।’
‘এমবাপ্পে আমার বাড়িতে আসত, আমরা একসঙ্গে ডিনারও করতাম। আমরা কয়েক বছর ভালো সময় কাটিয়েছি। কিন্তু এরপর যখন মেসি এলো, আমার মনে হয়, ও (এমবাপ্পে) একটু ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল। আসলে ও আমাকে কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাইত না (হাসি)। এরপর থেকেই ঝগড়া শুরু হয়, ওর আচরণে অনেক পরিবর্তনও আসে।’
২০২১ সালে চোখের জলে বার্সালোনা ছেড়ে লিওনেল মেসি যোগ দেন পিএসজিতে। সেই সময় মেসি, নেইমার ও এমবাপ্পেকে নিয়ে গড়া দলটির আক্রমণভাগ প্রতিপক্ষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালেও কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। এর জেরে শুরু হয় সমন্বয়হীনতা, একপর্যায়ে পিএসজি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। আলাপচারিতায় এই প্রসঙ্গটিও তুলে আনেন নেইমার।
‘ইগো থাকা সমস্যার কিছু না, কিন্তু তোমাকে বুঝতে হবে যে তুমি একা খেলতে পারবে না। তোমাকে অন্যদেরও পাশে রাখতে হবে। আমি সেরা, ঠিক আছে, কিন্তু কে তোমাকে বল দেবে? তোমার পাশে ভালো খেলোয়াড় থাকতে হবে, যারা বলে দিতে পারবে। এটা সবার ইগোর বিষয় ছিল… তাই এটা সফল হতে পারেনি।’
‘আজকের দিনে, কেউ যদি না দৌড়ায়, কেউ যদি একে অপরকে সাহায্য না করে, তাহলে জয় অসম্ভব।’
উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রতিভার অপচয় হিসেবে নেইমারকে বিবেচনা করা হয়। তার ওপর আছে তার বারবার চোটে পড়ার ঘটনা। এসব কিছুর নিয়ে পেছনে ফিরে তাকলে আক্ষেপ হয় কিনা— জবাবে নেইমার বলেন, ‘ক্যারিয়ারে আমি কোনোকিছু নিয়েই আক্ষেপ করি না।’
‘জীবনে ও ক্যারিয়ারে আমি যত ভুল করেছি, সেগুলো আমাকে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। তাই এখানে আক্ষেপের কিছু নেই।’
২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে পিএসজি ছেড়ে সৌদি আরবে যান নেইমার। ইউরোপ ছেড়ে সুদূর মরুর বুকে পাড়ি জমালেও চোট তার পিছু ছাড়েনি। সৌদি প্রো লিগের ক্লাব আল–হিলালে যোগদানের পরও চোটের কারণে বেশিরভাগ সময় তাকে থাকতে হচ্ছে মাঠের বাইরে।
আল