প্রবাসী অধ্যুষিত ফেনী জেলায় দিন দিন বাড়ছে হুন্ডি ও বিকাশের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রবাহ। যত্রতত্র হুন্ডি কারবার ও সহজলভ্য বিকাশের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ বাড়তে থাকায় জেলায় প্রকৃত রেমিটেন্সের হদিস মেলাতে পারছেনা সরকারী সংস্থাগুলো। ব্যাংকিং চ্যানেল বহির্ভূত এসব লেনদেনের কারণে জেলায় বেড়েছে কালো টাকার প্রবাহ ও নেতিবাচক প্রভাব। দ্রুত ব্যাংক বহির্ভুত লেনদেন বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা না নিলে প্রবাসীরা অবৈধ এ কারবারে আরো বেশি ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কাবোধ করছেন অর্থনীতিবিদরা। সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থনীতি গোয়েন্দা সংস্থা ও সিআইডি তদন্ত কার্যক্রম শুরু করলেও দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি জনসম্মুখে আসেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রেমিটেন্স আহরনের ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম অবস্থান দখল করে রেখেছে ফেনী জেলা। এ জেলা থেকে লাখ লাখ শ্রমিক উন্নত জীবন যাপনের প্রত্যাশা নিয়ে দেশের গন্ডি পেরিয়ে প্রবাসে পাড়ি দিয়েছে। যাদের মাধ্যমে অর্জিত রেমিটেন্সের সমৃদ্ধিতে ফেনী এখন দেশের অগ্রসরমান জেলা।
খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফেনী থেকে যে হারে প্রবাসে শ্রমিক যাচ্ছে; সে হারে ফেনীতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আসছে না। এতে করে সরকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি জেলার সামগ্রিক উন্নয়নে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শুধু তাই নয়; ব্যাংক বহি:র্ভুত রেমিটেন্সের টাকায় ফেনীতে গড়ে ওঠেছে এক ধরনের কালোবাজারী। যাদের টাকার ছড়াছড়িতে ফেনীতে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রবাসীরা জানান, আমরা যে কোন ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাতে চাইলে নির্ধারিত ব্যাংকে গিয়ে কারেন্সি জমা দিতে হয়। ওই কারেন্সির টাকা দেশের যে কোন ব্যাংক থেকে তুলতে ৪/৫ দিন সময় লাগে। টাকা তোলার জন্য প্রবাসীর পরিবারকে নির্ধারিত ব্যাংকে যেতে হয়। এতে করে একদিকে সময় ক্ষেপন হয়। অন্যদিকে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়। কিন্তুু হুন্ডিতে অথবা বিকাশে টাকা পাঠাতে সময় লাগে না। ওই টাকা তাৎক্ষণিক প্রবাসীর ঘরে গিয়ে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক বহি:ভূত চ্যানেলে টাকা পাঠালে একদিকে বিড়ম্বনার সম্ভাবনা থাকে না; অন্যদিকে ওই টাকা তাৎক্ষণিক প্রাপকের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়। এমতাবস্থায় প্রবাসীরা বিশেষ করে পরিবারের মাসিক খরচের টাকা বিকাশ ও হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের দিকে ফেরাতে সরকার নানামুখি কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। দেশের যেকোন ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠালে এক লাখে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। তারপরও ব্যাংকিং চ্যানেল বহি:ভূত রেমিটেন্স কার্যক্রম দু:খজনক বিষয়। এর থেকে প্রবাসীদের বের করে নিয়ে আসতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ কমে যেতে পারে।
কামরুন নাহার নামের এক প্রবাসীর স্ত্রী বলেন, তাদের পরিবারের মাসিক খরচের জন্য প্রতিমাসে তার স্বামী আবুদাবি থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠান। প্রথম দিকে এ টাকা একটি এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো। কিন্তুু এজেন্ট ব্যাংক থেকে টাকা পেতে ৪/৫দিন সময় লেগে যায়। যার কারণে গত ২/৩ বছর যাবত তার স্বামী তাদের নিকট আত্মীয়ের কাছে বাড়ির জন্য টাকা দেন। তারা পরদিনই ওই টাকা বাড়িতে পৌঁছে দেন। এতে করে দ্রুত টাকা পাওয়ার সাথে সাথে বিড়ম্বনা মুক্ত হই।
সৌদি আরব প্রবাসী মাহমুদুল হাসান বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাহিরে টাকা পাঠালে দেশের ক্ষতি তা আমি জানি। কিন্তুু আমার পরিবারে পুরুষ কোন সদস্য নেই। বাড়িতে আমার বৃদ্ধ বাবা–মা এবং স্ত্রী রয়েছেন। তাদের পক্ষে ব্যাংকে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করা কিছুটা কষ্ট সাধ্য। তাই বাধ্য হয়েই বিকাশে অথবা হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে বাধ্য হই।
তিনি আরো জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্সের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রবাসীর বাড়িতে টাকা পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম চালু করতে হবে। অন্যথায় মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে ব্যাংক বহি:ভূত লেনদেনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়তে পারে।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ফেনীসহ সারাদেশে অবৈধ হুন্ডি ও বিকাশের রেমিটেন্স মাধ্যমে রেমিটেন্স আসছে কিনা এ বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রেয়েছে। ইতোমধ্যে বিকাশ ড্রিস্ট্রিবিউটরশীপের আড়ালে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স লেনদেন হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে মাঠে কাজ করছে দেশের অর্থনীতি বিষয়ক তদন্ত সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিএফআইইউ এর তদন্তে পাওয়া তথ্য উপাত্ত নিয়ে কাজ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে বিকাশের মাধ্যমে রেমিটেন্স আসার অভিযোগ বারবার প্রত্যাখ্যান করে আসছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস)। একই দাবী করে আসছেন ফেনীতে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর রাজীব চৌধুরী।
ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সিআইডি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিএফআইইউ’র দেয়া প্রতিবেদন যাছাই–বাছাই করে ফেনীর ১৬ জন হুন্ডি কারবারীর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে সিআইডি। ফেনীতে আরো অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে সংস্থাটি।
তবে ফেনীর সচেতন মহল মনে করে, হুন্ডি ও বিকাশের নামে ডিজিটাল হুন্ডি বন্ধ করতে প্রবাসী পরিবারকে শুধু প্রণোদনা দিলেই হবে না। বরং হুন্ডি ও বিকাশ যেভাবে প্রবাসীর পরিবারে তাৎক্ষণিক টাকা পৌঁছে দিচ্ছে সেই ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অন্যথায় হুন্ডিতে রেমিটেন্স প্রবাহ কমানো সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক তায়েবুল হক বলেন, মূলত ডলার ক্রাইসিস টাইমে হুন্ডি ও ডিজিটাল হুন্ডির সাথে জড়িতরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা সরাসরি দালালের মাধ্যমে প্রবাসীদের থেকে ডলার সংগ্রহ করে দেশে থাকা তাদের সহোচরদের মাধ্যমে তা প্রবাসীর ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাহিরে লেনদেনে রাস্ট্র বঞ্চিত হয়; আর কালোবাজারীরা লাভবান হয়ে থাকে। ডলার ক্রাইসিস থেকে উত্তরণের আগে প্রকৃত অর্থে এ সমস্যা বন্ধ হবে না। দেশে অসৎ লোক বেড়ে যাওয়ায় এসব সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিক আকার ধারণ করা শুরু করেছে। তবে সরকারকে এ বিষয়ে আরো কঠোর হতে হবে। অন্যথায় এসব অবৈধ লেনদেনের বিস্তার ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
মোরশেদ আলম/দীপ্ত নিউজ