প্রতিবছর ৫ জুন এলেই আমরা কিছু গাছ লাগাই, কিছু র্যালি করি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “সবুজ পৃথিবীর” ছবি পোস্ট করি— তারপর আবার আগের চেনা জীবনে ফিরে যাই। অথচ যেই পৃথিবীটাকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলে এই দিবস, সেই পৃথিবীটিই আজ বারবার আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে— বাঁচো, নয়তো হারিয়ে যাও।
এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য— “ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ রোধ এবং খরা প্রতিরোধ”— শুধু মরুভূমির দেশগুলোর জন্য প্রাসঙ্গিক নয়; এটি বাংলাদেশের জন্যও এক অদৃশ্য সতর্কসংকেত।
আমাদের দেশে প্রতিবছর উজাড় হচ্ছে বন, সংকুচিত হচ্ছে আবাদি জমি, শুকিয়ে যাচ্ছে নদ–নদী, মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা। একদিকে উন্নয়নের নামে দখল–দূষণ, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এই ভূমি যেন প্রতিনিয়ত ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ নিয়ে বড় বড় প্রতিশ্রুতি, কিন্তু কাজ কতটুকু?
আমরা কথায় পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন বলি ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তা প্রায় সবসময়ই হয় পরিবেশ–অবমাননাকারী উন্নয়ন। সরকারি প্রকল্পে প্রাকৃতিক পরিবেশের মূল্যায়ন অনেক সময়েই হয় লোক দেখানো। বন উজাড় করে সড়ক নির্মাণ, নদী ভরাট করে হাউজিং প্রকল্প, পাহাড় কেটে রিসোর্ট— এসবই তো “উন্নয়নের” নামে বৈধতা পায়। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী এমন ক্ষতিগুলোর প্রথম শিকার কিন্তু আমরা নিজেরাই।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। অথচ আমরা এখনো এ বিষয়ে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় নীতিমালার অপেক্ষায়। কেবল এনজিও বা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি করে দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। পরিবেশ রক্ষাকে উন্নয়নের কেন্দ্রে না আনলে কোনো পরিকল্পনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
ব্যক্তিগতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন:
এই সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান চাবিকাঠি দুই জায়গায়— রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা ও নাগরিক অংশগ্রহণ। সরকারকে যেমন উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তেমনি নাগরিককেও দায়িত্ব নিতে হবে— ব্যক্তিগত জীবনে পরিবেশবান্ধব আচরণ চর্চার মাধ্যমে।
* একবার ভেবে দেখুন, আপনি যদি পলিথিনের পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করেন— সেটিও এক ধরনের প্রতিবাদ।
* যদি প্লাস্টিক বোতল ফেলে না দিয়ে পুনর্ব্যবহার করেন— সেটিও এক ধরনের পরিবেশরক্ষা।
* বছরে একটি গাছ লাগান, সেটির যত্ন নেন— সেটিও ভবিষ্যতের প্রতি একটি দায়বদ্ধতা।
শিক্ষায় পরিবেশবোধের অভাব:
আমাদের পাঠ্যবইয়ে পরিবেশ নিয়ে কয়েকটি অধ্যায় থাকলেও সেটি কেবল পরীক্ষার বিষয় হয়ে থেকে যায়। শিক্ষার্থীদের হাতে প্রকৃত সচেতনতা তুলে দিতে হলে তাদেরকে প্রকৃতির অংশ করে গড়ে তুলতে হবে। স্কুল পর্যায়ে “গ্রিন ক্লাব“, “পরিবেশ“, “গাছবন্ধু” কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
আজ থেকে শুরু হোক সত্যিকারের পরিবর্তন:
পরিবেশ ধ্বংসের দায় শুধু সরকারের নয়, শুধু শিল্পপতিরও নয়— এই দায় আমাদের সবার। আমরা কেউই বাইরে নই। যে গাছটি আপনি কাটলেন, সেটির অভাব আপনার সন্তানরাই টের পাবে। যে নদীটি আপনি দখল করলেন, সেটির বিপর্যয় আপনার গ্রামের কৃষককেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস তাই শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার দিন নয়— এটি আত্মসমালোচনার, দায়িত্ব নেওয়ার, এবং পরিবর্তনের শপথ গ্রহণের দিন। চলুন, আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করি— আমরা গড়বো এক সবুজ, বাসযোগ্য, সচেতন বাংলাদেশ। কারণ পরিবেশের প্রতি যত্ন নেওয়া মানে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎকেই বাঁচিয়ে রাখা।
এমএম/এসএ