কেউ হারিয়ে যায় রেলস্টেশনের ভিড়ে, কেউ অবহেলায় ঘর ছেড়েছে শিশুকালে, কেউবা জানেই না তার শেকড় কোথায়। কখনও নিকটতম স্বজনের স্নেহের পরশ পাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি তাদের। নেই প্রতিবেশী, নেই পরিচিত কেউ। পরিবারহীন এমন ১২ বন্ধু এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সবার স্বপ্ন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর।
অনিশ্চিত পথের জীবন থেকে উঠে আসা এই ১২ জন কিশোর হলেন; কবির হোসেন হৃদয়, সাব্বির হোসেন, সফিকুল ইসলাম, পারভেজ রানা, আব্দুল মজিদ, সুজন আলী, রাকিবুল হাসান, বজলুর রহমান বায়েজিদ, তাপস চন্দ্র রায়, জিহাদ মিয়া, আল আমিন ও হৃদয় কুমার।
ছোট থেকে তারা বেড়ে উঠেছেন পঞ্চগড়ের ‘আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে’। এ বছর পঞ্চগড় সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারা। এসএসসির সফলতায় তাদের যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। চোখে নতুন জীবন সাজানোর স্বপ্ন। তাদের এই অর্জন প্রমাণ করেছে ভালোবাসা, যত্ন আর সুযোগ পেলে যেকোনো শিশুই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এখন তাদের মত স্বপ্ন বুনছেন নগরীতে থাকা আরো ১৬০ জন পিতৃমাতৃহীন শিশু।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে অবস্থিত। অনাথ, ছিন্নমূল এবং বঞ্চিত ও হারিয়ে যাওয়া পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি।
জিপিএ– ৪.৯৬ অর্জন করেছেন কবির হোসেন হৃদয়। খুব ছোটবেলায় হৃদয়ের বাবা রিয়াজ ও মা রোকেয়ার বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকেই অবহেলার শিকার হতে থাকেন। এক পর্যায়ে মাত্র ৫ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে পালিয়ে এসে পথশিশুর পরিচয়ে জীবন শুরু করেন। ২০১৪ সালে কোন এক রেল স্টেশন থেকে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এই শিশু নগরীতে ঠাঁই হয় তার। ‘বাড়ি নারায়ণগঞ্জ’ এটুকুই মনে আছে হৃদয়ের। প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা–মায়ের কাছে ফেরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এই কিশোরের।
জিপিএ–৪.৮২ পাওয়া আব্দুল মজিদ জানান, লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের তুষভাণ্ডারে তার বাড়ি। বাবা–মা, পরিবার সবই আছে তার। খুব ছোটবেলায় বাড়ি থেকে হারিয়ে গেলে ঠাঁই হয় এখানে। পরবর্তীতে পরিবারের সন্ধান মিললেও এখানেই থেকে যান। তিনি বলেন, শুরুর দিকে খারাপ লাগলেও এখন ভালো আছি। এটাই আমার বড় ঠিকানা। এসএসসি পাস করবো এটা ছিল স্বপ্নের মত। পাস করেছি, এই অনুভূতি বোঝাতে পারবো না। পড়ালেখা শেষ করে ভাল কিছু করতে চাই।
জিপিএ–৪.৫৪ পেয়েছেন আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, আমার বাড়ি দিনাজপুরে এতটুকুই জানি। ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছি। এরপর ঠাঁই হয় এখানে। এখানে ৫ম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পাশের বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাস করে কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই এবং এ বছর এসএসসি পাস করি। ভালো রেজাল্ট করেছি, সামনে আরো ভালো করতে চাই।
সাব্বির হোসেনের রেজাল্ট জিপিএ–৪.৭৫। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হওয়া এই কিশোর জানে না তার বাড়ি কোথায়। তার শুধু মনে আছে বাবার নাম মারুফ এবং মায়ের নাম ছবি আক্তার। তিনি বলেন, কখনো কারো আদর স্নেহ পাইনি। আত্মীয় স্বজন কেউ আছেন কিনা তাও জানি না। এই শিশু নগরীই আমাদের ঠিকানা। এখানকার স্যারেরাই আমাদের অভিভাবক।
জিপিএ– ৪.৫০ পাওয়া সফিকুল ইসলামের মায়ের নাম সুখী আক্তার। কিন্তু মা–ছেলে দুজনই সুখহীন। সফিকুলও জানেন না তার বাড়ির ঠিকানা। শুধু মনে আছে, বাবার নাম আব্দুস সালাম এবং মা সুখী আক্তার। মা–বাবাকে খুঁজে পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা সফিকুলের। মাকে দেখতে চান প্রকৃত সুখী হিসেবেই।
একই রকম গল্প জিপিএ– ৪.২১ পাওয়া পারভেজ রানারও। শুধু মনে আছে– তার বাবার নাম হারুন এবং মা পারুল। খুব ছোটবেলায় পরিবার থেকে নিখোঁজ হলে সমাজকর্মীর মাধ্যমে এখানে ঠাঁই হয় তার।
সুজন আলী পেয়েছেন জিপিএ– ৪.১৪। তিনি জানান, বাবা আব্দুল হামিদ ও মা আম্বিয়া খাতুনের সঙ্গে কোন এক রেলস্টেশনে গিয়েছিলেন। সেখানে ভিড়ের মধ্য থেকে হারিয়ে যান। সুজন বলেন, শুধু মনে আছে কিশোরগঞ্জের ভৈরব আমাদের বাড়ি। বাবা–মার কথা খুব মনে পড়ে। জানি না কখনো তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবো কি–না!
জিপিএ–৩.৬৮ পাওয়া তাপস চন্দ্র রায় কখনই বাবাকে দেখেননি। তার জন্মের পর পরই নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন বাবা সুকুমার রায়। বেঁচে আছেন কি–না তাও জানেন না। শুধু জানেন তাদের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে। মায়ের নাম শিঞ্জিবালা। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরী কর্তৃপক্ষ জানান, বিভিন্ন বয়সী ১৬০ জন শিশু রয়েছে এখানে। এই ১২ জনের মত প্রত্যেকেরই গল্প হৃদয়বিদারক। অনেকেই রয়েছে পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া, জানেনা নিজের পরিচয়। আবার কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। এমনও আছে কারো বাবা–মা কেউ নেই। তবে এখানে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকছেন তারা। সময়মতো পড়ালেখা, খেলাধুলা আর আনন্দ বিনোদনে সময় পার করেন তারা।
শিশু নগরীর শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, শিশুদের এখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এরপর তারা মাধ্যমিকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়। সদ্য এসএসসি পাস করা ১২ জনও এখান থেকেই প্রাথমিক শেষ করেছিল। শিশুদের যাবতীয় খরচসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।
শিশু নগরীর কৃষি কর্মকর্তা সেলিম প্রধান বলেন, বিভিন্নভাবে বঞ্চিত শিশুদের এখানে ঠাঁই হয়। শুরুর দিকে শিশুরা থাকতে না চাইলেও একটু বড় হওয়ার পর তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে এটাই তাদের মূল ঠিকানা। এখানে শিশুরা নিজের বাড়ির মতই থাকে, পড়ালেখা করে। এ পর্যন্ত এখানে থাকা ২৪ জন এসএসসি পাস করেছে।
তিনি আরও বলেন, আহছানিয়া মিশনের উদ্দেশ্য হলো– এই শিশুদের ১৮ বছর পূর্ণ হলে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সদ্য এসএসসি পাসদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।
আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীর সেন্টার ম্যানেজার দিপক কুমার রায় বলেন, অন্ধকারে পা বাড়ানো শিশুদের আলোর পথে নিয়ে আসে আহছানিয়া মিশন। তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে এই শিশু নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ১২ জন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সবাই ভালো ফলাফল করেছে। এটা একটা বড় অর্জন বলে মনে করি। এখানে থাকা অন্য শিশুরাও ক্রমান্বয়ে সুফল বয়ে আনবে।