নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এক চরম অনিশ্চয়তা ও ভঙ্গুর অর্থনীতির বোঝা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল নবনির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসান হলেও তৎকালীন বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা ছিল খাদের কিনারায়। রপ্তানি আয় ছিল সীমিত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তলানিতে এবং অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়ের কোনো শক্তিশালী কাঠামো ছিল না। এমন এক সংকটময় মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি কেবল রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আনেননি, বরং সাহসিকতার সাথে দেশের অর্থনৈতিক দর্শনেও আমূল পরিবর্তন ঘটান। তার গৃহীত সংস্কার কর্মসূচিগুলোই মূলত একটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনীতিকে আধুনিক মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে ধাবিত করেছিল।
মুক্তবাজার অর্থনীতির ভিত্তি ও ভ্যাট প্রবর্তন:
খালেদা জিয়ার অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রথম বড় সোপান ছিল ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট (VAT) প্রবর্তন। তৎকালীন সময়ে এই সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয়। আজ বাংলাদেশের বাজেটের বড় একটি অংশ এই ভ্যাট থেকেই আসে। ভ্যাট প্রবর্তনের পাশাপাশি তিনি আমদানি শুল্কের হার কমিয়ে বিশ্ববাজারের সাথে দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতার পথ তৈরি করে দেন। এর ফলে স্থবির হয়ে পড়া ব্যবসা–বাণিজ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়।
পোশাক শিল্পের বিপ্লব ও নারীর কর্মসংস্থান:
এই সময়কালেই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ‘তৈরি পোশাক শিল্প’ একটি সুসংগঠিত কাঠামো পায়। প্রথম মেয়াদে তার সরকার পোশাক শিল্পের বিকাশে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা এবং ব্যাক–টু–ব্যাক এলসি (LC) প্রথার যে সুযোগগুলো সম্প্রসারণ করেছিল, তা দেশের হাজার হাজার উদ্যোক্তাকে সাহসী করে তোলে। ফলস্বরূপ, মাত্র কয়েক বছরে কয়েকশ কারখানা থেকে হাজারো কারখানায় উন্নীত হয় এই খাত, যেখানে লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল। এটি কেবল অর্থনীতিকেই চাঙ্গা করেনি, বরং সামাজিক ক্ষমতায়নেও এক অনন্য বিপ্লব ঘটিয়েছিল।
শিক্ষা খাতে বৈপ্লবিক বিনিয়োগ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন:
মানবসম্পদ উন্নয়নে খালেদা জিয়ার ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি এবং ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি চালুর সিদ্ধান্তটি ছিল বৈপ্লবিক। দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত হওয়ার ফলে ঝরে পড়ার হার কমে আসে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করে। এই দক্ষ ও শিক্ষিত জনবলই পরবর্তীকালে দেশের উৎপাদনশীলতা ও রেমিট্যান্স প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি:
২০০১–২০০৬ মেয়াদে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে তিনি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দিকে বিশেষ নজর দেন। সেই সময়ে বিশ্ববাজারে মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ থেকে ক্রমাগত বেড়ে প্রায় ৭ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন—যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা এবং গ্রামীণ সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ সহজ করা হয়। একই সাথে টেলিকম খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিয়ে তিনি তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল যোগাযোগের প্রাথমিক ভিত্তিটি স্থাপন করেন।
সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটি নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে দেশকে টেনে তুলে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের যে প্রাথমিক ভীত, তা নির্মিত হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেই। শৃঙ্খলিত অর্থনীতিকে মুক্ত করে বেসরকারি খাতের হাতে ছেড়ে দেয়া এবং সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের অংশীদার করার ফলেই বাংলাদেশ আজকের এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাত ধরে শুরু হওয়া ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়াই মূলত আধুনিক বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে।