বুধবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৫
বুধবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০২৫

তারেক রহমানের চোখে-মুখে নিঃশব্দ শোক

Avatar photoদীপ্ত নিউজ ডেস্ক

মাকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ তারেক রহমানের নিস্তব্ধ অমলিন চোখে যেন রাজ্যের শোক। হাসপাতালে মায়ের কাছে ছিলেন শেষ সময় পর্যন্ত। পরে ফিরে যান বাসায়। সেখানে মায়ের জন্য দোয়া প্রার্থনা সেরে বাসভবন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যান রাজনৈতিক কার্যালয়ে।

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরের দিকে তারেক রহমান দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে যান। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানে সৃষ্টি হয় নতুন পরিবেশ।

গত বৃহস্পতিবার ১৭ বছর পর তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটি উদ্‌যাপন করা হচ্ছিল, কিন্তু ঠিক উল্টো চিত্র ছিল মঙ্গলবার। নেতাকর্মী ও অনুসারীদের চোখে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হারানোর অশ্রু। গুলশান কার্যালয় জুড়ে শোকের ছায়া।

সেই শোকের ছায়া পড়েছিল তারেক রহমানের মুখেও। কয়েক ঘণ্টা আগেও হাসিমুখে ছিলেন, কিন্তু পরদিন ভোর এনে দিল মাকে হারানোর চিরস্থায়ী বেদনায় গাঁথা। তাই তো বৈঠকে পাথর হয়ে বসেছিলেন তারেক রহমান।

বেগম খালেদা জিয়ার মরদেহ বহনের সমগ্র আলোচনা যখন টেবিলে, তখন মাকে হারিয়ে বুকের ভেতর শূন্য তারেক রহমানের। একদিকে মায়ের মৃত্যু, অন্যদিকে তাঁর রেখে যাওয়া দায়িত্বের ভার। কোন দিক সামলাবেন তারেক রহমান! তার অসহায় অস্ফুট নির্বাক চোখ যেন এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিল।

মায়ের মৃত্যুর সময় তারেক রহমান তার শয্যাপাশেই ছিলেন। বিএনপির চেয়ারপারসনের চিকিৎসায় সার্বক্ষণিক পাশে থাকা তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালে মঙ্গলবার ভোর ৬টায় মারা যান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এ সময় তার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। অস্থিরতায় তিনি নীরবে ছটফট করেছেন।

এজেডএম জাহিদ আরও বলেন, প্রথমে তারেক রহমানকে একাই আইসিইউতে যেতে দেওয়া হয়েছে। এরপর পরিবারের সবাই ভেতরে যান। শেষ সময়ে তারেক রহমান তার মায়ের পাশে থেকে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।

হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের শেষ মুহূর্তে তারেক রহমানের স্মৃতির মানসপটে হয়তো ভেসে উঠছিল দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় মায়ের অবিচল লড়াইয়ের স্মৃতি। দীর্ঘ সময় ধরে দূরে থাকায় মায়ের সেবা করতে না পারার আক্ষেপ।

বাবা জিয়াউর রহমানকে হারিয়ে মা খালেদা জিয়া যখন রাজপথে নেমেছিলেন, তখনও তার পাশেই ছিলেন তারেক রহমান। সে সময় তার বয়স ছিল খুবই কম। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ বদলে গেলে দেশের পাশাপাশি আঘাত জিয়া পরিবারেও লাগে। এই আঘাত তারেক রহমানকে দেশ ছাড়া করে। এর আগে তাকে সইতে হয় ভয়াবহ শারীরিকমানসিক নির্যাতন। একই ভাগ্য নেমে এসেছিল ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর ক্ষেত্রেও। কোকো তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন খালেদা জিয়ার ছোটপুত্র কোকো। ভাইকে শেষ দেখার সুযোগ হয়নি তারেকের। তখন খালেদা জিয়া এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়।

এর তিন বছরের মাথায় কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এই যাত্রায় জিয়া পরিবার ও বিএনপি নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়েন। পরবর্তী অধ্যায়ে খালেদা জিয়ার একের পর এক অসুস্থতার খবর পায় দেশবাসী।

গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্যে গিয়ে চিকিৎসা নেন দেশনেত্রী। সেবার দলের নেতাকর্মীরা আশা করছিলেন, তাদের নেত্রী সহসাই তাদের ছেড়ে যাবেন না। ভোট দেবেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রকাশ্যে না এলেও আড়ালে থেকে দিকনির্দেশনা দেবেন। কিন্তু গত ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। দেশের মানুষের প্রার্থনায় ঠাঁই পান তিনি। এর মধ্যে বিদেশে নেওয়া, বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে আসাসহ সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁর বিমানযাত্রা করার মতো শারীরিক অবস্থা ছিল না। হয়ত মহান সৃষ্টিকর্তাও চেয়েছিলেন, এই আপসহীন নেত্রীর বিদায় বাংলাদেশের মাটিতেই হোক। কারণ খালেদা জিয়ার সারাজীবনের আকাঙ্ক্ষাপ্রতিজ্ঞাই ছিল‘আমি দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানাও নেই।’

খালেদা জিয়া হয়ত শেষ অপেক্ষা করছিলেন বড় ছেলে তারেকের জন্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের রাজসিক প্রত্যাবর্তন দেখতে। সব বাধা কাটিয়ে ছেলে এলেন লালসবুজের দেশে। কাড়লেন পুরো দেশের নজর। সেই চিত্র প্রচার করা হয় বিদেশি গণমাধ্যমেও। কিন্তু পাঁচদিনের মাথায় তারেক মা হারানোর বেদনায় শোকাহত হলেন।

জীবনের কিছু বুঝে ওঠার আগে ১৯৮১ সালে বাবাকে হারান তারেক রহমান। এরপর ভাইকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে নেমে পড়েন দেশ গড়ার লড়াইয়ে। কিন্তু পথিমধ্যে ভাইকেও হারান। সেই মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। নির্যাতনের ক্ষতেই দুনিয়া ছাড়তে হয়েছিল আরাফাত রহমান কোকোকে।

এক দশকের বেশি সময় পর আবারও পরিবারের সদস্যের মৃত্যু সংবাদ! তবে এবার এতিম হলেন তারেক রহমান। বাবা ও ভাই হারানোর শোক তিনি ভুলতে চেয়েছিলেন ‘আম্মার’ চোখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সেই চোখও বুজে গেল চিরতরে।

তবে বিদায়বেলায় তারেককে কিছু বার্তা দিয়ে গেলেন খালেদা জিয়া। শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশ ও দেশের মানুষকে ছেড়ে না যাওয়া এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া। দেশ রক্ষায় ও মানুষের জন্য প্রয়োজনে নিরাপদ জীবনের বদলে কণ্টকাকীর্ণ পথ বেছে নেওয়া। মাকে ছাড়া একা হয়ে পড়া তারেকের জন্য লড়াই হয়ত সহজ হবে না। কিন্তু গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে সেই দীর্ঘ পথতো পাড়ি দিতেই হবে।

আরও পড়ুন

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More