তিন দিনের মাঝে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবারও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন রিকশাচালকরা।
ঢাকার গুলশান, হাতিরঝিল, বাড্ডা, বনশ্রী, মগবাজার ইত্যাদি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে যে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অটোরিকশার সংখ্যা বেশ কম।
কারণ বেশিরভাগ অটোরিকশা চালকই মহাখালী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ইত্যাদি এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করায় ব্যস্ত। তাই বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে প্যাডেল চালিত রিকশার আধিক্য।
আন্দোলনের মাঝেও যারা আজ সড়কে রিকশা চালাতে নেমেছে, তাদের বেশ কয়েকজন রিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয়েছে বিবিসি বাংলা’র। তেমনই একজন হলেন আবুল কালাম।
অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই তার পাল্টা প্রশ্ন, “ছাত্র আন্দোলনে ৮০ শতাংশ রিকশার ড্রাইভার ছাত্রদের সাথে ছিল। তা কি এই দিনটা দেখার জন্য?”
তাকে বলতে শুনে চারদিক থেকে আরও অনেক রিকশাচালক এগিয়ে আসেন। তাদের একজন মো. মুসা। গতকাল তারা রিকশা চালাতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “কালকে রাতে আমার আব্বা কল দিছে, টাকার লইজ্ঞা। কী করমু? কালকে ইনকাম করছি মাত্র ৭০০ টাকা। তার মাঝে জমা দেওয়া লাগে ৬০০ টাকা। বাকি ১০০ টাকা আমি খামু নাকি তারে দিমু?”
“আমি এক ছেলে, আমার বাবা–মাকে প্রতিমাসে টাকা দেই। আমি যদি রিকশা চালাইতেই না পারি, বাবা–মাকে টাকা দিমু কেম্নে, আর সংসারই বা চলবে কেম্নে,” বলছিলেন বরিশালের এই রিকশাচালক।
মূল আপত্তি তার ‘গতিতে’
অটোরিকশার চলাচল নিয়ে আপত্তির প্রধান কারণ ‘নিয়ন্ত্রণহীন গতি’।
এই কথাটি অস্বীকার না করলেও এর বিপরীতে ভোলার মো. আব্দুল হকের যুক্তি হলো, “কেউ কেউ স্পিডে চালায়। কিন্তু জ্যাম পড়লে তো সবাই এক নিয়মেই চালায়। কারণ রাস্তায় বাচ্চা–কাচ্চা থাকে।”
নদীভাঙ্গনে ঘরবাড়ি–সহায় সম্বল হারিয়ে অভাবের তাড়নায় আজ থেকে ৪৩ বছর আগে রিকশা চালানো শুরু করেন আব্দুল হক। জীবনের সিংহভাগ সময় চট্টগ্রামের পথে পথেই কেটেছে তার।
ওইসময় তার “গায়ে শক্তি ছিল, পায়ে চালিত রিকশা চালাতে অসুবিধা হইতো না”। কিন্তু বয়স বাড়ার পর পায়ে চালিত রিকশা চালানোটা কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য।
তাই গত ১৫ বছর ধরে অটোরিকশা চালানো শুরু করেন তিনি। “সরকার মেইন রোডে ওঠাটা নিষেধ কইরা দিক। আমরা গলিতে তো চালাইতেই পারি,” বলছিলেন চার সন্তানের জনক মি. হক।
যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রধান সড়ক না, দীর্ঘমেয়াদে শাখা সড়কেও অটোরিকশা চলতে চেওয়া উচিৎ না। কারণ তার অনিয়ন্ত্রিত গতির জন্য সে নিজেকে, অন্য বাহনকে ও পথচারীকে বিপদে ফেলবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরই) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারি চালিত তিন চাকার যানবাহনের কারণে সারাদেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মাঝে ৫৮২টিই ছিল মারাত্মক।
এআরই’র সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান জানান, এগুলোর মাঝে একটা বড় সংখ্যাই হলো অটোরিকশা এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা বাস্তবে নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, “এই বাহনের ব্রেকিং সিস্টেম–কাঠামো এত দুর্বল, এটি এত ঝুঁকিপূর্ণ বাহন…এ নিয়ে বিতর্ক করার কোনও সুযোগ আমি এখানে দেখছি না।”
“যানবাহনের স্ট্যাবিলিটি নির্ভর করে তার সেন্টার অব গ্রাভিটি কোথায় আছে, তার ওপর। কিন্তু পায়ে চালিত রিকশায় যখন বৈজ্ঞানিকভাবে দুই–চারটা ব্যাটারি বসানো হচ্ছে, তখন তার গ্রাভিটি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে এবং তাকে একটি ভারসাম্যহীন বাহনে পরিণত করছে।”
“সেজন্য দেখবেন যে কোনও মোড়ে যখন এরা দ্রুত বেগে বাঁক নিচ্ছে, তখন এরা উল্টায়ে পড়ে যাচ্ছে। কারণ তার সেন্টার অব গ্রাভিটি জায়গামতো নাই,” যোগ করেন তিনি।
বন্ধ করতে গেলে উভয় সংকট
অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান একদিকে যেমন বলছেন যে ধীরে ধীরে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করতেই হবে, অপরদিকে তিনি এও অস্বীকার করছেন যে অটোরিকশা বন্ধ করাটা বাস্তবে বেশ জটিল।
কারণ ঢাকা শহরে এখন অগণিত অটোরিকশা রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, সংখ্যাটি প্রায় ১২ লাখ।
“গত পাঁচই অগাস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অসংখ্য নতুন রিকশা ঢাকায় এসেছে। সেটা আরেকটা ডিজাস্টার। তারা মনে করেছে, ঢাকায় আয় বেশি,” বলছিলেন তিনি।
“সংখ্যাটা এখন ব্যাপক এবং এর সাথে জীবন জীবিকা জড়িত। কিন্তু এখানে নিরাপত্তার দিকও তো ভাবতে হবে। নিরাপত্তার জায়গায় আমি ছাড় দেওয়ার পক্ষে না। কারণ জীবিকার কথা বলে অটোরিকশা চলাচলের অনুমোদন দেওয়া অন্যদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”
অটোরিকশা বন্ধের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল রিকশা ব্যবহারকারীদের মধ্যেও।
আজ কয়েকজন পথচারী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তারা অটোরিকশা বন্ধ করার পক্ষে। কিন্তু তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে দুম করে বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ হবে না।
ইকরাম করিম নামক একজন এই প্রশ্নও করেছেন, “এই যুগে এসে পায়ে চালিত রিকশা কেন?”
মি. করিমের মতে কারও কারও মতে, প্রয়োজনে অটোরিকশার গতি সীমিত করে দিক।
অনেক রিকশা ব্যবহারকারীর অটোরিকশার পক্ষে অবস্থানের বিষয়ে অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের ভাষ্য, “যেসব যাত্রীরা বলছে, কারণ তারা এখনও ঝুঁকিতে পড়েনি। তারা গতিকে উপভোগ করছেন। যারা দুর্ঘটনায় পড়েছে তারা কিন্তু বলবে এই অবৈজ্ঞানিক বাহন আজকেই বন্ধ করা উচিৎ।”
তবে ঢাকায় অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করা কখনোই সহজ হবে না বলে মনে করে ট্রাফিক পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পাবলিক সহযোগিতা না করলে সম্ভব না। তাদেরকে আমরা কিছু বললে এখনও তারা তেড়ে আসে।”
“একটা সিগন্যালে আমরা পুলিশ মাত্র দুইজন। আর এইখানে অটোরিকশা এখন অন্তত ৫০টা। আজকে বিক্ষোভ না থাকলে এই সংখ্যা দুই–তিনগুণ হইতো। এদের সামলানো তো কঠিন।”
অটোরিকশা নিয়ে কী ধরনের বিড়ম্বনার মাঝে পড়তে হয় জানতে চাইলে বাড্ডার একজন ট্রাফিক পুলিশ বলেন, “তারা বাইক–গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়া চালায়। থামালেও থামে না।”
“ধরেন, কারও ওড়না রিকশার চাকায় লাগলো। পায়ে চালিত রিকশা হইলে সাথে সাথেই থামাতে পারে। আর অটোরিকশারে থামাতে বললে থামাতে থামাতে সে আরও অনেক দূর চলে যাবে। ততক্ষণে গলায় ফাঁস লাগবে। রাস্তায় পড়ে যাবে। মাথা ফাটবে। কপাল খারাপ হলে মরতেও পারে।”
সমাধান কী হতে পারে?
২০০৩ সালের দিকে চীন থেকে পুরোপুরি বাহন হিসেবে ইজিবাইক আসতো বাংলাদেশে কিন্তু ২০১২–২০১৩ সালের দিকে “জিনিসপত্র লোকালি অ্যাসেম্বল” করা শুরু হয়।
“চীন থেকে যা আসতো, তা কিছুটা হলেও বিজ্ঞানসম্মত ছিল। কিন্তু পরে আমাদের লোকাল গ্যারেজগুলোতে রিকশার সাথে মোটর লাগিয়ে অটোরিকশা বানানো শুরু হলো,” বলছিলেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
“মোটর লাগালেই মোটরাইজড ভেহিকল হয় না” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যেহেতু রাতারাতি অটোরিকশা বন্ধ করাটা জটিল, তাই আপাতত মূল সড়কে এই ধরনের যানবাহন বন্ধ করতে হবে।”
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও বলছিলেন, আপাতত শাখা সড়কে অটোরিকশা চলুক।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সংস্করণের রিকশা দেখা যায়। সেগুলোর একেকটার ধরন, আকার–আকৃতি, একেকরকম।
“এর মূল কারণ, রিকশার জন্য বাংলাদেশে এখনও কোনও টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন বা স্ট্যান্ডার্ড নাই। বাংলাদেশের টেকনিশিয়ানদের জন্য একটি স্পেসিফিকেশন বা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে দেওয়া দরকার। তাদের প্রশিক্ষণ থাকলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না,” বলছিলেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
“আপনি এখন বলছেন রাস্তায় আটকাবেন। কিন্তু আপনি যত রিকশা সরাবেন, তার চেয়ে বেশি জন্ম হচ্ছে। কারণ আপনার গ্যারেজের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই। মোটর ব্যাটারি চীন থেকে এনে সংযোজন হচ্ছে। আপনি কেন আমদানি বন্ধ করলেন না?” যোগ করেন তিনি।
“আবাসিক মিটারের অনুমতি নিয়ে অটোরিকশা চালকরা বাণিজ্যিকভাবে ব্যাটারিতে চার্জ করছে, আপনি কেন চার্জিং স্টেশনে নিয়ন্ত্রণ করছেন না?” যোগ করেন তিনি।
এছাড়া, “কিছু আছে, ২০–৩০ হাজার টাকা খরচ করলে মোডিফিকেশনের সুযোগ আছে। কিন্তু যেগুলা একেবারেই প্যাডেল রিকশা, সেগুলো ইম্প্রোভাইজ করতে পারবেন না। সরাতেই হবে।”
তার মতে, এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দিলে অটোরিকশার এই উল্লম্ফন বন্ধ করা সম্ভব।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতে, অটোরিকশা বিষয়ে কৌশলী হতে হবে এবং কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। এখন শাখা সড়কে চলার অনুমতি দিলেও মাথায় রাখতে হবে হবে যে সেই সড়কের সক্ষমতার সাথেও সংখ্যার সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
“আপাতত তাদেরকে সময় দেওয়া যেতে পারে। ওই সময়ের মাঝে যারা টেকনিক্যালি ঠিকঠাক থাকবে, তারা শাখা সড়কে থাকবে। বাকিরা থাকতে পারবে পারবে না,” বলেন তিনি।
“আপাতত অটোরিকশা চালকরা অটোরিকশাকে পায়ে চালিত রিকশা হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। মূল কথা হলো, পায়ে চালিত রিকশা হিসাবে তার জন্ম। তাকে সেভাবেই ধরে রাখতে হবে,” বলছিলেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।
তথ্য সূত্র: বিবিসি
সুপ্তি/ দীপ্ত সংবাদ